করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের ‘সুনামি’ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। মহামারিকালের দুই বছরের সব রেকর্ড এবার ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থা ঠেকাতে প্রথমে ১১ দফা নির্দেশনা জারি করে সরকার। পরিস্থিতি অনুকূলে না আসলে স্কুল-কলেজ বন্ধ, সরকারি-বেসরকারি অফিসে টিকা সনদ বাধ্যতামূলকসহ আরও পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়।
ওমিক্রন ঠেকাতে আরও আগেই (১৩ ডিসেম্বর) সবধরনের জনসমাগম সীমিত করার সুপারিশ করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কমিটির সভাপতি অধ্যাপড ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিন, ‘সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সব সামাজিক (বিয়ের অনুষ্ঠান, মেলা ইত্যাদি), ধর্মীয় (ওয়াজ মাহফিল) ও রাজনৈতিক সমাবেশ এ সময় বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে জাতীয় কমিটি।’ পরে ওই মাসের শেষ দিকে জারি করা ১১ দফা নির্দেশনার মধ্যে বলা হয়, ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা এবং রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে টিকার সনদ দেখাতে হবে। সেইসঙ্গে উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়।
আর গত শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি হওয়া পরিপত্রে দুই সপ্তাহের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তাতে আরও বলা হয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি জমায়েত করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগদান করবে তাদের অব্যশই টিকা সনদ বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট আনতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাণিজ্য মেলার মতো অনুষ্ঠান চালু রাখার সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে প্রশ্ন উঠেছে, করোনা কি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হানা দেয়? বাণিজ্যমেলা খোলা রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করা হলো সে প্রশ্ন করেছেন কেউ কেউ।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন শনাক্ত আর শনাক্তের হার কমলেও বেড়েছে মৃত্যু। তবে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ গতকাল (২১ জানুয়ারি) শুক্রবার হওয়ায় পরীক্ষা কম হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২১ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে ২২ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৬১৪ জন। আর এ সময়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনাক্তের হার ২৮ দশমিক দুই শতাংশ।
২১ জানুয়ারি অধিদফতর জানিয়েছিল, ২০ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে ২১ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হন ১১ হাজার ১১ হাজার ৪৩৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের। শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
শনিবার করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৩৪ হাজার ৩১১টি, আগের দিন পরীক্ষা হয়েছিল ৪০ হাজার ১৩৪টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যেভাবে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে, সেভাবে টেস্ট হচ্ছে না। নানা ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ টেস্ট করাতে আসে না। আর টেস্ট না হলে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না। তাদের মতে, সরকারি হিসাবে যত মানুষ শনাক্ত হচ্ছেন, প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত মানুষেরর সংখ্যা অনেক বেশি।
২১ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতিতে বিশেষ এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেন। যেকোনও জনসমাগমে যেতে হলে টিকার সনদ লাগবে এবং এটা সব জায়গায় প্রযোজ্য হবে বলে জানান।
তাহলে বাণিজ্য মেলা খোলা থাকছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বইমেলা, স্টেডিয়াম, বাণিজ্যমেলাসহ সব জায়গায় এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে, সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’ অথচ সংক্রমণের এ অবস্থায় বাণিজ্য মেলা চালু রয়েছে, যেখনে হাজারো মানুষের সমাগম।
জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘এটা বন্ধ করে দিতে পারলে ভালো হতো। অনেস্টলি স্পিকিং, এটা বন্ধ করা খুব দরকার ছিল। বাণিজ্যমেলা চালু রাখার কোনও যুক্তি নেই। আমরা মনে করি, এটা এমন কোনও প্রয়োজনীয় বিষয় না, এটা বন্ধ রাখা উচিত।’
সরকারের ১১ দফা, ৫ দফার মতো বিষয়গুলো নিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্দেশনা দেওয়া এক বিষয়, আর সেগুলো কার্যকর করা আরেক বিষয়। হোটেল-রেস্তোরাঁয় টিকার সনদ দেখিয়ে যেতে হবে, বাণিজ্যমেলায় টিকার সনদ দেখিয়ে যেতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, গণপরিবহন সেক্টরের জন্যও নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু আমরা কি সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছি?’
‘বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যেভাবে করা উচিত, সেটা হচ্ছে না-সমস্যাটা এ জায়গাতেই। সেইসঙ্গে যারা ঘরের বাইরে গেলে এখনও মাস্ক পরছে না, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে’, বলেন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক সহিদুল্লা।
কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘বাণিজ্য মেলার মতো জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষ চলাফেরা করবে, টিকার সনদ দেখিয়ে ঢুকবে—এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না। কমিটির পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে জনসমাগম বন্ধ করার জন্য, ভিড় এড়িয়ে চলার জন্য। কিন্তু সেটা হচ্ছে কোথায়?’
বাণিজ্য মেলা থেকে সংক্রমণ আরও ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেভাবে ওখানে মানুষ যাচ্ছে, তাতে করে ওখান থেকে সংক্রমণ আরও ছড়াবে। সংক্রমণ আকাশচুম্বী হচ্ছে। আর যেহেতু ব্যাপকভাবে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না, সেজন্য সংক্রমণের হার এবং শনাক্ত রোগীর সংখ্যার যে প্রকৃত চিত্র সেটা আমরা পাচ্ছি না। প্রকৃত রোগীর সংখ্যা সরকারি হিসেবের কয়েকগুণ বেশি। এ অবস্থায় কোনোভাবেই বাণিজ্যমেলা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত মহামারি নিয়ন্ত্রণ করার মতো সিদ্ধান্ত নয়।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা বন্ধ করে দিতে পারলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু এর সঙ্গে অনেকেরই জীবন ও জীবিকা জড়িত।’
‘বিজ্ঞানকে চোখের সামনে নিয়ে আসতে হবে, আর তাতে মানুষ সচেতন হবে’ উল্লেখ করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘র্যাপিড অ্যান্টিজেন ব্যাপকভাবে চালু করতে হবে। বাণিজ্যমেলার মতো ভিড়ের জায়গায় গাড়ি নিয়ে র্যাাপিড অ্যান্টিজেন করা গেলে খুব ভালো হতো। আমিতো বলি, গাড়ি নিয়ে ভিড়ের জায়গায় ঢুকে যাওয়া উচিত। আসেন, আপনারা টেস্ট করে যান বিনা পয়সায়। তাতে করে মানুষ আগ্রহী হবে আর চোখের সামনে দেখবেও। এটা করা গেলে খুব উপকার হতো,’ বলেন ডা. মুশতাক।
তিনি বলেন, ‘সেখানে ১০০ জন মানুষের মধ্যে কতজন পজিটিভ হয়- সে চিত্রটাও সামনে আসবে। আর যখন চোখের সামনে এটা আসবে তখন মানুষ কিছুটা হলেও ভয় পাবে। তাই র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট খুব দরকার ওখানে।’
‘বিজ্ঞান যখন সামনে আসবে তখন মানুষ সহজেই বুঝবে—প্রকৃত অবস্থাটা কী এবং কোন পর্যায়ে রয়েছে’, বলেন মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।