বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে শ্রীলঙ্কান সরকার সেখানকার স্কুল-কলেজে পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে। কাগজ-কলম আমদানি বন্ধ রেখে কিছুটা বৈদেশিক মুদ্রা যদি বাঁচে, তা তারা নিত্যপণ্য আমদানিতে কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু এই সংকটের মধ্যেও শ্রীলঙ্কান কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে।
দেশটির একটি খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান (সুপারশপ চেইন) বাংলাদেশের নামকরা প্রতিষ্ঠান আগোরা কেনার জন্য একটি অপ্রকাশিত চুক্তি করেছে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে আগোরোর নিয়ন্ত্রণ নেবে প্রতিষ্ঠানটি। তবে নিজ দেশের সংকটের মধ্যে কোম্পানিটি কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের অর্থ পরিশোধ করবে, তা কোনো পক্ষই বলছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার সফটলজিক রিটেইল হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশের আগোরা লিমিটেডের শতভাগ শেয়ার কেনার জন্য ইতিমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যার মূল লেনদেন দেশের বাইরে সংগঠিত হবে বলে জানা যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে কথা বললে কর্মকর্তারা জানান, বিক্রির প্রস্তাবটি তারা পাননি।
আগোরা ও সফটলজিক রিটেইলের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়টি দেখভাল করছেন ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার (বিডি)-এর ম্যানেজিং পার্টনার ও সিইও খালিদ কাদির। তিনি জানান, আগোরা বিক্রির জন্য শ্রীলঙ্কার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তারা কীভাবে এই অর্থ পরিশোধ করবে এটা তাদের বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। উল্লেখ্য, ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার আগোরার শেয়ারহোল্ডারও।
কোম্পানি অধিগ্রহণ বিষয়ে কয়েক জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, শ্রীলঙ্কার বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে অবৈধ কালো টাকার ব্যবহার ছাড়া বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত রিটেইল কোম্পানি কোনার ঘোষণা বাস্তবায়ন করা একেবারেই অসম্ভব। অধিগ্রহণের চুক্তিটি অপ্রকাশিত হওয়ায় এবং সরকারের কোনো সংস্থার রেগুলেশনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় এক্ষেত্রে দেশের বাইরে বিপুল অঙ্কের লেনদেন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এসব ক্ষেত্রে কর ফাঁকিসহ বিপুল বৈদেশিক মূদ্রা পাচারের আশঙ্কা করা যায়। বাংলাদেশে খুচরা ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা না থাকার সুযোগে বিদেশি কোম্পানিগুলো শতভাগ অধিগ্রহণের সুযোগ নিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। তারা জানান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো দেশেও বিদেশিদের খুচরা ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিমালা রয়েছে।
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ এ বিষয়ে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের নীতিমালা রয়েছে। তবে খুচরা ব্যবসা খাতের জন্য আলাদা কিছু নেই। যেহেতু এই ব্যবসায় বিনিয়োগ কম, সেক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ এখনো এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়নি, সেহেতু আমরা এক্ষেত্রে একটি নীতিমালা করতে পারি। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কাজটি কঠিন হয়ে পড়বে। লজিস্টিক ব্যবসার ক্ষেত্রে এসংক্রান্ত নীতিমালা আছে। তবে হাইকোর্টে রিট করার কারণে তা আটকে আছে।
উল্লেখ্য, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শর্তসাপেক্ষে সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ, নেপালে শূন্য শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় শর্তসাপেক্ষে খুচরা ব্যবসা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এসংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় নামমাত্র বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ কেনার মাধ্যমে বিপুল দেশীয় অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও অন্যান্য দেশের নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশও খুচরা ব্যবসার নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এসব নীতিমালার মধ্যে রয়েছে—সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান, ন্যুনতম এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সুযোগ রাখা, কমপক্ষে ৩০ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশের ক্ষুদ্র শিল্প থেকে সংগ্রহ করা, প্রতিটি আউটলেটে কমপক্ষে ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ, প্রতিটি মেট্রোসিটি আউটলেটের বিপরীতে দুটি গ্রামীণ আউটলেট প্রতিষ্ঠা, স্হানীয় ও বহুজাতিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্হানীয় অর্থ না নেওয়া উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব নিয়মকানুন থাকলেও বাংলাদেশে এটি নেই। এর ফলে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।