বাংলাদেশের বিগত বছরগুলোতে আমরা বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের ঘটনা আমরা পরিলক্ষ্যিত করি, ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড এবং যে প্রাণহানির ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের, বিশেষ করে আরএমজি সেক্টরকে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার জন্য এটি ছিল একটি জেগে ওঠার আহ্বান। তারপরেই রানা প্লাজা বিপর্যয়, এসব ঘটনা বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরকে তাদের কর্ম-পরিবেশে সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের তাগিদকে প্রভাবিত করে। পরবর্তি বছরগুলোতে আরএমজি সেক্টর যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করে যাতে করে এ সেক্টরে জীবন ঝুঁকি অনেক হ্রাস পেয়েছে ।
সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাক এর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেছেন, ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) এর সভাপতি জহির উদ্দিন বাবর।
তিনি বলেন,এবার যদি সাম্প্রতিক কালে কিছু ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোকে লক্ষ্য করি। প্রথমেই আসি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন, যেটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এ ঘটনায় পুরান ঢাকায় রাসায়নিক জ্বালানির আগুনে ৭১ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। তারপর নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমতল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে একটি বিস্ফোরণ ঘটে, এতে ৩৭ জন গুরুতর আহত এবং ৩৪ জন নিহত হন। মসজিদে এয়ার কন্ডিশনার বিস্ফোরন হয়ে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে বলে ধারণা করা হয়। ২০২১ সালের ০৩ জুলাই রাজধানীর বড় মগবাজারে আউটার সার্কুলার রোডে বাণিজ্যিক ভবন ‘রাখি নীড়-এ ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় ১১ জন নিহত এবং প্রায় ৫০ জন আহত হয়। গ্যাস লিকেজের কারনে এই বিস্ফোরন ঘটে বলে ধারনা করা হয় । সাম্প্রতিক সময় ঢাকার চকবাজারের দেবিদ্বারঘাট এলাকায় অবস্থিত একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। সবথেকে সাম্প্রতিক সময় ৫ জুন ২০২২ তারিখে চট্রগ্রামের সীতাকুণ্ডে বি এম কন্টেনার ডিপোতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা যেখানে অর্ধ-শতাধিত নিহত এবং ২০০ জনের বেশি মানুষ আহত হন। এ অগ্নিকান্ডের উদ্ধারকার্য পরিচালনা করতে যেয়ে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী আহূতি দেন। এসব ঘটনায় যে পরিমাণ প্রানহানি এবং হতাহত হয়েছে তা সত্যি বেদনাদায়ক, হৃদয়স্পর্শি এবং এর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও কিন্তু অনেক। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এবারের সব ঘটনাগুলো ঘটছে অন্যান্য শিল্প-কারখানায় (আরএমজি সেক্টর ব্যাতীত) বা, কোন বাণিজ্যক ভবনে বা, সাধারন কোন আবাসিক/ পাবলিক স্থাপনায়।
জহির উদ্দিন বাবর বলেন,রানা প্লাজা ঘটনার পর আরএমজি সেক্টরে কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক এবং অগ্নি নিরাপত্তার উন্নয়নের জন্য যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছিল আমাদের উচিত একিভাবে অন্য সকল খাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহন করা। শুধুমাত্র একটি সেক্টরকে মাথায় না রেখে সকল ক্ষেত্রের জন্য উপযোগী একটি ফায়ার সেফটি বিধিমালা প্রণয়ন করা। সবধরনের বাণিজ্যিক ভবন, শিল্প, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প, পাবলিক বিল্ডিং, আবাসিক ভবন, শপিং সেন্টার, কারখানা, গুদাম, ডেটা সেন্টার, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্টেডিয়াম ইত্যাদির জন্য সর্বশেষ অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত তথ্য উপলব্ধ বিষয়াবলী এই বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। সরকারী বেসরকারী সকল পর্যায়ে স্বমন্বয় করে এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
তিনি জানান, আমাদের দেশে বিভিন্ন আবাসিক, কারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধক ব্যবস্থা এবং নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ থাকা এখন একটি সময়ের দাবী। এ বিষয়ে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল সবাইকে অগ্নি-নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করা। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইসাব) ২০১৩ সাল থেকে একটি অলাভজনক বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশের সার্বিক অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণে ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইসাব)-এর দেড় শতাধিক সদস্য প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ সংগঠন প্রতিবছরের মত এবারও ৮ম বারের মত আন্তর্জাতিক মানের ফায়ার সেফটি এবং সিকিউরিটি সরঞ্জাম প্রদর্শনীর আয়োজন করছে। বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ইসাবের এ আয়োজনের সাথে কো-পার্টনার হিসেবে রয়েছে। বিশ্বের ২৬ টি দেশ থেকে ১০০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করবে এবং তাদের ব্রান্ডের আগ্নি নির্বাপক, প্রতিরোধক, নিরাপত্তা বিষয়ক নানাবিধ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির উপস্থাপন করবেন।
“৮ম ইন্টারন্যাশনাল সেফটি এন্ড সিকিউরিটি এক্সপো-২০২২”- শীর্ষক এ প্রদর্শনী ৩ দিন ব্যাপী আগামী ২৪ নভেম্বর ২০২২ থেকে ২৬ নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে। “৮ম ইন্টারন্যাশনাল সেফটি এন্ড সিকিউরিটি এক্সপো-২০২২” সবধরণের দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে । বাংলাদেশের সর্বসাধারনকে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আরো সচেতন করাই এ প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য। প্রদর্শনীর সাথে সাথে এখানে ৪ টি টেকনিক্যাল সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে যে কোন ব্যক্তি তার পছন্দমত বিষয়ের উপর টেকনিক্যাল সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে পারবে। অংশগ্রহণকারীকে সেমিনার শেষে সার্টফিকেট প্রদান করা হবে। এই প্রদর্শনীর প্রথম দিন ঢাকার বিভিন্ন স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে তাদের সামনে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দক্ষ ফায়ার ফাইটাররা একটি শিক্ষামুলক লাইভ ডেমন্ট্রেশন প্রোগ্রাম পরিচালনা করবেন। এছাড়া এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষন হিসেবে থাকছে ইসাব সেফটি এক্সসিলেন্স এওয়ার্ড ২০২২। যারা বিভিন্ন সময় কষ্ট করে যারা তাদের আবাসিক বা, কমার্শিয়াল বা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করেছেন তাদের উৎসাহিত করা এবং স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই এই এওয়ার্ড প্রোগ্রাম।
“৮ম ইন্টারন্যাশনাল সেফটি এন্ড সিকিউরিটি এক্সপো-২০২২”- বাংলাদেশের ফায়ার সেফটি এবং সিকিউরিটির আধুনিকায়নে ও এ বিষয়ক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে সবাইকে জানাতে, এবং বিভিন্ন স্থাপনায় এগুলোর ব্যবহারে উৎসাহিত করবে। অত্যাধুনিক আগুন নির্বাপক মেশিনারী, যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির সংগে পরিচিতির মাধ্যমে আমাদের ব্যবসাখাত সম্পর্কে শিল্পদ্যোক্তাসহ সকল দর্শনার্থীরা এসব ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করতে পারবেন। সর্বপরি বাংলাদেশের ফায়ার সেফটি এবং সিকিউরিটি সম্পর্কিত মেশিনারীজ এবং যন্ত্রাংশের আধুনিকায়নে এবং তা ব্যবহারের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ও কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। আমি সবাইকে “ইন্টারন্যাশনাল সেফটি এন্ড সিকিউরিটি এক্সপো-২০২২”-এ উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করছি ।