বিমা গ্রাহকের প্রিমিয়াম ও বিমা জালিয়াতি, প্রতারণা ও অনুমোদন ছাড়াই অনিয়মিতভাবে উৎসাহ বোনাস প্রদানসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে জীবন বীমা করপোরেশেনের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী আদায়কৃত অর্থ করপোরেশনের ব্যাংক হিসাবে জমা না করে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া মুনাফার পাঁচ শতাংশ সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা না করার মতো অনিয়মও করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ছয়টি প্রতিবেদনে প্রায় ৪৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোপাটের তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হলো এক. ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন আইন-১৯৯৭ ও বিমা করপোরেশন আইন-২০১৯ অনুযায়ী করপোরেশনের মোট মুনাফার পাঁচ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা; দুই. বিমা গ্রাহকের প্রিমিয়াম ও বিমাপত্র জালিয়াতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা; তিন. আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন ব্যতীত উৎসাহ বোনাস দেয়ায় করপোরেশনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় আট কোটি ৪৮ লাখ টাকা; চার. বকেয়া ভাড়া আদায় না হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা; পাঁচ. ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ লঙ্ঘন করে অনিয়মিতভাবে লাঞ্চ সাবসিডি পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সাত কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং ৬. আদায়কৃত অর্থ করপোরেশনের ব্যাংক হিসাবে জমা না করে আত্মসাৎ করেছে প্রায় ১৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন জীবন বীমা করপোরেশনের ২০১৮-১০ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক কার্যক্রমের ওপর কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়। সম্প্রতি এ রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। ছয়টি প্রতিবেদনে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
জীবন বীমা করপোরেশনের ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে দেখা যায় ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন আইন-১৯৯৭ ও বিমা করপোরেশন আইন-২০১৯ অনুযায়ী করপোরেশনের মোট মুনাফার পাঁচ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় প্রায় ২২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা সরকারের ক্ষতি হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৯-১০ সালের দ্বিবার্ষিক মূল্যায়নে সরকারি মুনাফা বাবদ চার কোটি সাত লাখ, ২০১১-২০১২ সালের দ্বিবার্ষিক মূল্যায়নে সরকারি মুনাফা বাবদ পাঁচ কোটি, ২০১৩-১৪ সালের দ্বিবার্ষিক মূল্যায়নে সরকারি মুনাফা বাবদ ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ সালের দ্বিবার্ষিক মূল্যায়নে সরকারি মুনাফা বাবদ সাত কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৯-২০১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত দ্বিবার্ষিক মূল্যায়ন মোতাবেক সরকারি মুনাফা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বমোট ২২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বিপুল এই অর্থ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন আইন-১৯৯৭ ও বিমা করপোরেশন আইন-২০১৯ অনুযায়ী জীবন বীমা করপোরেশন মোট মুনাফার পাঁচ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমাযোগ্য হলেও তা জমা করা হয়নি।
জীবন বীমায় কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাবে জবাবদিহি ও যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নানা রকম অনিয়ম বাড়ছে। বড় কর্তারা অবৈধ সুবিধা নিয়ে এসব অপকর্ম করে চলছে। এর আগে সিলেটে জনবল নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়ম হয়।’
এদিকে ঢাকার নিয়ন্ত্রণাধীন সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা কর্তৃক ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিমা গ্রাহকদের প্রিমিয়াম ও বিমাপত্র জালিয়াতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। জীবন বীমার নিরীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ডেপুটি ম্যানেজার বি কে বৈদ্য (অবসর) জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ১২ বিমা গ্রাহকের প্রিমিয়াম বাবদ প্রায় ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এদিকে ঢাকা রিজিওনাল অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় একই ধরনের অপরাধ করেন আরেক উন্নয়ন অফিসার-১ অফিসার তাকভীর হোসেন (সবুজ)। তিনি আত্মসাৎ করেন প্রায় সাত লাখ সাত হাজার টাকা। এসব অর্থ আদায়ের দিন অথবা বিশেষ কারণে আদায়ের পরের দিন জীবন বিমার সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে জমা করার নিয়ম থাকলেও তা না করে আত্মসাৎ করেন এ দুই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে উৎসাহ বোনাস-সংক্রান্ত ক্যাশ বই, বোনাস সিট, বেতন বিল রেজিস্টার নিরীক্ষাকাল দেখা যায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন ব্যতীত বোনাস দেয়ায় সরকারের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আট কোটি ৪৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
সূত্র জানায়, বকেয়া ভাড়া আদায় না করায় পাঁচ কোটি ২৫ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে কতিপয় জীবন বিমার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ভাড়াটিয়াদের যোগসাজশে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বকেয়া ভাড়া আদায়ে নানারকম টালবাহনা করে সরকারি হিসাবে জমা না করে নিজেরা লাভবান হতে এসব অর্থ বিকল্পভাবে ব্যবহার করে। জীবন বীমা করপোরেশনের ঢাকার নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, স্থান, স্থাপনা ও বাড়ি থেকে বকেয়া ভাড়া আদায় না হওয়ায় করপোরেশনের বিপুল এই অর্থ থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জীবন বীমার করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়, ঢাকা ও মুক্তি জেনারেল হাসপাতাল, জীবন বীমা ভবন (৩য় তলা), ১৫০ বঙ্গবন্ধু রোড, নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রতি বর্গফুট ১৪ দশমিক ৭৬ টাকা হারে আট হাজার ৮৯৭ বর্গফুট জায়গার মাসিক ভাড়া (৮৮৯৭–১৪.৭৬) বা এক লাখ ৩১ হাজার ৩১৯ দশমিক ৭২ টাকা ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পরিশোধের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময় ১০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে ২০১৮ সালের ১ মে থেকে ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চুক্তি সম্পাদন করা হলেও এই সময় পর্যন্ত ভাড়াটিয়ার কাছে পাওনা বাবদ রয়েছে। একইভাবে বকেয়া রয়েছে চট্টগ্রামের ভাড়া প্রদানকৃত স্থান, স্থাপনা ও বাড়ি থেকে ভাড়া আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় চার কোটি ৫৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ যোগসাজশে এসব অর্থ আদায়ে গড়িমসি করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের প্রায় পাঁচ কোটি ২৫ লাখ টাকার আর্থিকভাবে ক্ষতি করা হয়েছে।
এদিকে দ্বিতীয় গ্রেড থেকে দশম গ্রেড কর্মচারীদের লাঞ্চ সাবসিডি বাবদ প্রতিদিনের জন্য ২০০ টাকা প্রদান করে আসছে জীবন বীমা করপোরেশন। ঢাকায় প্রায় তিন কোটি ১৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, রংপুরে প্রায় ৭০ লাখ ১৬ হাজার টাকা, খুলনায় প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ও চট্টগ্রামে দুই কোটি ১২ লাখ ২১ হাজার টাকা অনিয়মতভাবে প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ চার বিভাগে প্রায় সাত কোটি ১৩ লাখ সাত হাজার টাকা অনিয়মিতভাবে প্রদান করা হয়েছে, যারা প্রাপ্য নয় তাদেরও এই সাবসিডি দেয়া হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে জীবন বীমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুল হক চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অডিটের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জবাব দিয়েছি। তবুও আরও কোনো ত্রুটি থাকলে সেগুলো আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। আপনি যেসব অনিয়মের কথা বলেছেন, সবগুলোই আমরা আবারও তদন্ত করব। আমরা সব অনিয়মের বিরুদ্ধে।’
তথ্যসুত্রঃ শেয়ার বিজ