যে কোনো দেশের রপ্তানি খাতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত। বর্তমানে দেশের রপ্তানির ৯৮ শতাংশই ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে অন্যান্য দেশের রপ্তানিতে ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্যের মধ্যে মধ্য ও উচ্চপর্যায়ের প্রযুক্তিপণ্যসহ অন্যান্য ধরনের পণ্যের পরিমাণ বাড়লেও বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে মোট রপ্তানির মধ্যে মধ্যম ও উচ্চ প্রযুক্তি পণ্যের অনুপাত মাত্র দুই শতাংশ। অথচ ১৯৯০ সালের দিকেও মধ্যম ও উচ্চ প্রযুক্তি পণ্যের অনুপাত ছিল ছয় শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনাযোগ্য অন্যান্য দেশগুলোর রপ্তানি পণ্যে প্রযুক্তি খাতের অবদান ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশে সেটি হচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল ‘টেকনোলজি ইউজ ইন দ্য ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ন, সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত। সম্মানিত আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির ও জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থার (ইউনিডো) কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ জাকি উজ জামান।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় করতে চায় না। বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান বছরে শ্রমিকপ্রতি ৫০০ টাকারও কম ব্যয় করে। ইউসুফ সাদাত বলেন, ‘শিল্প খাতে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ভালো মানের গবেষণা ও উদ্ভাবন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর এ খাতে ব্যয় করার প্রবণতা খুব কম। ওষুধ, চিকিৎসা ও রাসায়নিকের মতো কয়েকটি শিল্প ছাড়া বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান বছরে শ্রমিকপ্রতি ৫০০ টাকারও কম ব্যয় করে।’
সৈয়দ ইউসুফ সাদাত বলেন, ‘শিল্প প্রতিষ্ঠানের আকারের ভিত্তিতে দেখলে এই পরিস্থিতি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আমাদের দেশের বড় শিল্পের মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এই বিনিয়োগ যথাক্রমে ২ ও ১ শতাংশ। বিষয়টি আমাদের শিল্প খাতের জন্য অশনিসংকেত।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ না করলে ও ভালো মানের গবেষণা না হলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এখনও অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বিনিয়োগ হচ্ছে না। বৈদেশিক বিনিয়োগ সেভাবে আসছে না। অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারি মালিকানার কয়েকটি শিল্প বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ, প্রযুক্তি দরকার। বেসরকারি খাতে গেলে এটা ভালোভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’
শিল্পমন্ত্রী আরও বলেন, ‘দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যা পড়াচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষায় ছাড় দেয়া যাবে না। প্রযুক্তিনির্ভর একটা শিল্প কাঠামো গড়ে তুলতে দক্ষ জনবল প্রয়োজন। বাংলাদেশিরা অনেক দ্রুত শিখতে পারে। আমাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সমস্যা একটাই; অসহনশীলতা। সব সময় আরও চাই, আরও চাই।’
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শিল্প খাতে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে যেভাবে বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে, তাতে এর সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। বিষয়গুলো নিয়ে অনেক কথা হলেও আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। এক তৈরি পোশাক খাত ছাড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে বলার মতো কোনো খাত নেই। আবার পোশাক খাতেও যে আমরা খুব ভালো প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারছি, তাও না।’
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিএমসিসিআই) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, ‘মেগা প্রকল্পে যেসব প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার হয়েছে বা এখনও হচ্ছে, তার ছিটেফোটা কাজ যদি দেশের কোম্পানিগুলো পেত, তাহলে এখানকার কোম্পানিগুলো দাঁড়িয়ে যেত। বলছি না যে, বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আনা যাবে না। তবে এসব প্রকল্প যখন শুরু হয়, তখন চুক্তিতে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের শর্ত দেয়া উচিত ছিল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য ব্লকচেইন, আইওটির মতো বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা প্রয়োজন। ডাটা প্রাইভেসি আইনকে দ্রুত আলোর মুখ দেখাতে হবে।’