চীনের কট্টর বিরোধীতা সত্ত্বেও তাইওয়ান সফর করেছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)-এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তার এই ঝটিকা সফর মারমুখী উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে এ অঞ্চলে। একইসঙ্গে, বৈশ্বিক কম্পিউটার চিপ সরবরাহ চক্রে- দ্বীপটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দিকেও আলোকপাত করেছে।
তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে একটিই প্রতিষ্ঠান– তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি)।
চীনকে রুষ্ট করা এই সফরে এসে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মার্ক লিউ- এর সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন আমেরিকান স্পিকার। এই ঘটনা আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে নিয়ন্ত্রণের অপরিহার্য গুরুত্বকে স্পষ্ট করেছে। আরও তুলে ধরেছে, বিশ্বের সর্বাধুনিক সব চিপ প্রস্তুতে টিএসএমসি'র একান্ত জরুরি অবদান।
আধুনিক বিশ্বে জীবনযাপনের সর্বত্র রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর এর অবদান। আমাদের স্মার্টফোন থেকে শুরু করে মোটরকার, রেফ্রিজারেটর, যুদ্ধাস্ত্র– প্রযুক্তির সকল অগ্রগতি আর ভোক্তা বাজারের প্রসার– চিপের ব্যবহার আজ সকল খাতে অপরিহার্য।
এই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল খাত হয়ে উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা। আর তার প্রাণকেন্দ্রেই রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। মহামারির পর চিপ সংকটও দেখা দেয়। এর পর এশিয়ার অন্যান্য অগ্রসর দেশের সাথে এটি তৈরির প্রতিযোগিতায় আদাজল খেয়ে নেমেছে আমেরিকা। এর মাধ্যমে শিল্পটিতে চীনের চেয়ে এগিয়ে থাকাকেও ধরে রাখতে চাইছে।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক বৈশ্বিক ঝুঁকি ও কৌশলগত পরামর্শক সংস্থা ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট- এর এশিয়া গবেষণা শাখার প্রধান রিমা ভট্টাচার্য বলেন, 'তাইওয়ানের অমীমাংসিত কূটনৈতিক মর্যাদার বিষয়টি চরম ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার উৎস হয়েই থাকবে। পেলোসির সফর উভয় দেশ (যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের) জন্য তাইওয়ান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ– সেদিকে আলোকপাত করেছে'।
তিনি আরও বলেন, এই গুরুত্বের সুষ্পষ্ট কারণ– 'চিপ প্রস্তুতকারক হিসেবে, বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ চক্রে তাইওয়ানের সম্পৃক্ততা'।
রিমা মনে করেন, পেলোসির টিএসএমসি কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ প্রমাণ করে— চিপ শিল্পে চীনকে আর একা টেক্কা দিতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য আমেরিকা সর্বাধুনিক চিপ প্রস্তুতে আধিপত্যকারী এশীয় কোম্পানিগুলোর সাথে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়।
টিএসএমসি কেন এত গুরুত্বের
টিএসএমসি একটি 'ফাউন্ড্রি'। অর্থাৎ, তাদের কারখানায় অন্য কোম্পানির ডিজাইন করা চিপ প্রস্তুত করা হয়। অ্যাপল ও এনভিডিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের সেরা সেরা সব প্রযুক্তি কোম্পানি টিএসএমসি'র দীর্ঘদিনের গ্রাহক।
অন্যদিকে, গত ১৫ বছরে চিপ উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে আমেরিকা। একইসময়, আরও উন্নত চিপ উৎপাদন প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে টিএসএমসি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ইলেকট্রনিক্সের মতো এশীয় কোম্পানি।
এশীয় কোম্পানিগুলি প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির জন্য এখনও যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল হলেও– টিএসএমসি বিশ্বের সেরা চিপ প্রস্তুতকারক হিসেবে নিজ অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চ সংস্থার তথ্যমতে, বৈশ্বিক ফাউন্ড্রি বাজারের ৫৪ শতাংশ টিএসএমসির দখলে। আর একক দেশ! (চীন যা নিজ ভূখণ্ড দাবি করে) হিসেবে বৈশ্বিক ফাউন্ড্রি বাজারের দুই-তৃতীয়াংশ তাইওয়ানের দখলে। তাইওয়ানিজ আরও দুটি বড় কোম্পানি ইউএমসি ও ভ্যানগার্ড এই অবস্থান তৈরিতে অবদান রেখেছে।
এসব তথ্যই বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে তাইওয়ানের অতুলনীয় গুরুত্বের বার্তা দেয়।
আবার স্যামসাং বৈশ্বিক ফাউন্ড্রি শিল্পের ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আঞ্চলিকভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, এশিয়াই চিপ প্রস্তুতে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
পেলোসির টিএসএমসি চেয়ারম্যানের সাথে সাক্ষাৎ ছিল এই নেতৃত্বের স্বীকৃতি।
তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষায় আমেরিকার দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে মার্কিন স্পিকার আরও বার্তা দিয়েছেন, কোনোমতেই এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ- চীনের হাতে চলে যেতে দেবে না ওয়াশিংটন।
তাইওয়ানে আগ্রাসনের আশঙ্কা:
গণতান্ত্রিক ও নিজস্ব সরকার ব্যবস্থায় শাসিত তাইওয়ানকে একটি বিদ্রোহী প্রদেশ বলেই মনে করে বেইজিং। চীনের নীতি হলো- অবশ্যই তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সাথে একই শাসন কাঠামোর অধীনে আনতে হবে। একারণেই পেলোসি আসার আগে- কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে এই সফর না করার ব্যাপারে সতর্ক করে বেইজিং।
মার্কিনীরা এসব হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত করেনি। তাই পেলোসির সফরকালেই সামরিক মহড়া শুরু করে চীনের সামরিক বাহিনী, যা সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করে।
পশ্চিমাদের শুধু আশঙ্কা নয়, তারা ভালো করেও জানে– তাইওয়ানে চীনের আগ্রাসন বৈশ্বিক চিপ শিল্পে শক্তির ভারসাম্যে বড় রদবদল ঘটাবে। এর মাধ্যমে বেইজিংয়ের হাতে এমন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হস্তগত হবে– যা তাদের কাছে নেই।
এই আগ্রাসনের পর বাকি দুনিয়ায় (আসলে পশ্চিমা দেশে) সর্বাধুনিক চিপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে এমন ভয় রয়েছে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের।
চীন তাইওয়ান দখল করলে টিএসএমসি-কে 'জাতীয়করণ' করবে বলে মনে করেন পরামর্শক সংস্থা- সেন্টার ফর ইনোভেটিং দ্য ফিউচার- এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অভিশুর প্রকাশ। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি ও তাদের প্রযুক্তিকে নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের সাথে যুক্ত করতে পারবে বেইজিং।
যদিও টিএসএমসি চেয়ারম্যান বলেছেন, তাইওয়ানে আগ্রাসন চালালে তার কোম্পানি 'অচল' হয়ে পড়বে; আর তাতে চীনের আদৌ কোনো লাভ হবে না।
তিনি জোর দিয়েই বলেন, 'জবরদস্তি করে কেউ টিএসএমসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না'।
আমেরিকা যা করছে
এখন এশীয় চিপ জায়ান্টদের আমেরিকায় উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহিত করছে ওয়াশিংটন। স্থানীয় শিল্পকেও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিচ্ছে সরকারি সমর্থন।
এরমধ্যেই, মার্কিন জায়ান্ট ইন্টেল- এর সিইও প্যাট গেলসিঙ্গার নিজ কোম্পানির ফাউন্ড্রি ব্যবসাকে আধুনিকায়নের বড় উদ্যোগ নিতে শুরু করেছেন। এতদিন ইন্টেল চিপ উৎপাদনে টিএসএমসি'র থেকে পিছিয়ে পড়েছিল।
আমেরিকার উৎসাহে, এরমধ্যেই অ্যারিজোনায় ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সর্বাধুনিক একটি কারখানা নির্মাণ করছে টিএসএমসি।
গত সপ্তাহে এ শিল্পের জন্য ৫২ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ পাস করেছে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)। 'চিপস অ্যান্ড সায়েন্স' অ্যাক্টের আওতায় এর অনুমোদন দেয়া হয়। এর মূল্য উদ্দেশ্য আমেরিকার চিপ শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধি।
চীনের জন্য চিপ শিল্পের প্রযুক্তি কেনার সুযোগ যাতে আরও সীমিত হয়–সেদিকটাও বিবেচনায় রেখেছেন মার্কিন আইনপণেতারা।