৯ হাজার কোটি টাকার অবৈধ ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরই মধ্যে সংস্থাটি দারাজের অনিয়ম সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে দারাজের চিফ অপারেশন অফিসারকে (সিওও) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবও করা হয়েছে। আজ রবিবার সকালে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। সিআইডির তদন্ত ছাড়াও আরও একাধিক সংস্থা দারাজের ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির আইনি দিক খতিয়ে দেখছে। সেই সঙ্গে তাদের পণ্য বিক্রির তথ্যউপাত্ত চাওয়া হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে ১১/১১ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করায় দারাজকে শোকজ নোটিশও দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও দারাজের বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দারাজের ব্যাংকিং লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে সিআইডি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
প্রাপ্ত তথ্যউপাত্ত বলছে, দারাজের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা বিদেশি ব্যাংকের ভার্চুয়াল কার্ড, গেমস ও সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন ধরনের অনুমোদনহীন ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রি করে আসছে। বিদেশ থেকে আনা এসব ভার্চুয়াল পণ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে এমন অভিযোগের তথ্য সিআইডির হাতে রয়েছে। ভার্চুয়াল কার্ডের মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ পাচারের পাশাপাশি আন্তঃদেশীয় অপরাধের আশঙ্কা করছেন সিআইডির কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিদেশি ব্যাংকের ভার্চুয়াল কার্ড বিক্রির অনুমোদন নেই। এ ধরনের ব্যবসা অবৈধ। দারাজের কর্মকর্তারা ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির কথা স্বীকার করলেও বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ছায়া তদন্ত চালিয়ে দারাজের অনুমোদনহীন অবৈধ পণ্য বিক্রির প্রমাণ পায় সিআইডি। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট দারাজের বিরুদ্ধে নানামুখী তদন্ত শুরু করে। অবৈধ পণ্য বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় সিআইডি গত ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দারাজের ব্যাংক হিসাব তলব করে। অর্থপাচার, কর ফাঁকি ও অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রির অভিযোগে দারাজের বিরুদ্ধে শিগগিরই মামলা করা হচ্ছে বলেও সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘একজন ব্যক্তি বিদেশি ব্যাংকের কার্ড নিয়ে নিজে ব্যবহার না করে তা অন্যের কাছে বিক্রি করতে পারেন না। অনলাইনে বিদেশি ব্যাংকের যে ভার্চুয়াল কার্ড বিক্রি হচ্ছে, সেটার বৈধতা নেই তাদের। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানই বিদেশে টাকা পাঠাতে পারে। অন্য যারা লেনদেন করছেন, তারা অবৈধ পন্থায় করছেন।’
বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে বিদেশি ব্যাংকের ভার্চুয়াল কার্ডের বৈধতা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলেই রাতারাতি এটা করতে পারব না। এ জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা করতে হবে।’
দারাজের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিদেশি ব্যাংকের ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড, ফিক্সড কার্ড ও রিচার্জএবল কার্ড বিক্রি করে। ইউরোপসহ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ভিনদেশিদেরও নাম পরিচয় দিয়ে কার্ডগুলো তৈরি করা হয়েছে। ভার্চুয়াল পণ্যের মধ্যে রয়েছে নেটফ্লিক্স ও অ্যামাজনসহ বিভিন্ন চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশন, সফটওয়ারের এক্টিভেশন ও সাবস্ক্রিপশন, বিভিন্ন গেমস ও তার ডেভেলপমেন্ট টুলস, বিদেশি ই-কমার্সের গিফট কার্ড, গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপস স্টোরের গিফট কার্ড।
সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিক্রি হওয়া ভার্চুয়াল পণ্যের বৈধতা আছে কিনা, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানো অর্থপাচার আইনে অপরাধ। বিদেশি কার্ডসহ ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির মাধ্যমে অর্থপাচার হয়েছে কিনা, সেটিও তদন্ত করা হচ্ছে।’
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে গত এক বছরে ভার্চুয়াল পণ্যের বাজার ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার। যার প্রায় পুরোটাই অবৈধ। এসব ভার্চুয়াল পণ্য কিনতে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। বাংলাদেশে ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির ৯০ ভাগ বাজার দখল করে আছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজ। বাকি ১০ ভাগ বিক্রি হয় কিছু ই-কমার্স ও এফ কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ভার্চুয়াল পণ্যগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে আমদানি করা হলে বাংলাদেশ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেত। কারণ হিসেবে সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান ভার্চুয়াল পণ্য আমদানির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব ও অদক্ষতার কারণে দেশ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দারাজে মোবাইল ফোন, জামা-কাপড় কিংবা ভোগ্যপণ্য বিক্রি হয় মূলত ১০ শতাংশ। আর ৯০ ভাগই ভার্চুয়াল পণ্য। এটাই তাদের মূল ব্যবসা। গত এক বছরে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দারাজে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রি হয়েছে। বিক্রি করা ভার্চুয়াল পণ্যের কোনো অনুমোদন নেই। এসব পণ্য বিক্রির জন্য সরকারকে যে কর দেওয়ার কথা, সেটাও তারা দেয় না। ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির কারণ হিসাবে কর্মকর্তারা বলেন, ই-মেইল কিংবা পেনড্রাইভের মাধ্যমে খুব সহজে দেশে আনা যায়। ভার্চুয়াল পণ্যের কোনো রিটার্ন নেই। পণ্য রাখার জন্য ওয়্যার হাউসেরও দরকার হয় না। লাভও বেশি। তাই এসব অবৈধ পণ্যের দিকে ঝুঁকছে দারাজ।
দারাজে অবৈধ পণ্য বিক্রি ও অর্থপাচারের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) মাহবুব হাসানের সাথে। তিনি এ বিষয়ে তাদের মিডিয়া শাখায় যোগাযোগ করতে বলেন। মিডিয়া শাখায় যোগাযোগ করলে লিখিত প্রশ্ন দিতে বলা হয়। লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর পর দারাজের মিডিয়া শাখার মাধ্যমে লিখিত জবাব পাঠান প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ. এইচ. এম. হাসিনুল কুদ্দুস রুশো। তাতে বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন ভার্চুয়াল পণ্য দারাজে ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। কোনো ব্যবসায়ী দারাজের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে চাইলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। কাগজপত্র যাচাই করে ডিজিটাল পণ্য দারাজে আপলোড করা হয়। তবে অবৈধ পণ্য বিক্রি ও বিদেশে টাকা পাচারের ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
দারাজের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দারাজ কোনো টাকা বিদেশে পাচার করেনি। বাংলাদেশ থেকে ভার্চুয়াল কার্ড ও পণ্য কেনার টাকা বিদেশে পরিশোধ করার সুযোগ না পেয়ে আলী বাবার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিএমসিসি (দুবাই) থেকে টাকা পরিশোধ করা করা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। দিকনির্দেশনা পেলে তারা ডিএমসিসিকে টাকা পরিশোধ করে দেবে।
তবে সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, দারাজ কোনো বৈধ পথে পণ্য আমদানি করেনি। অবৈধ পথে আনা পণ্য তারা বিক্রি করতে পারে না। এখন যদি বিদেশ থেকে সেই টাকা পরিশোধ করাও হয়, তা হলেও তারা অপরাধ থেকে পার পাবে না।
বিদেশি কার্ডের মাধ্যমে অর্থপাচারের ব্যাপারে সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, দারাজ থেকে কার্ড কিনে তার নম্বর ও পিন নম্বরের ছবি তুলে যে কোনো দেশের নাগরিকের কাছে পাঠিয়ে দিলে তারা অর্থ উত্তোলন করতে পারবে। এভাবে লাখ লাখ ডলার দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি সিরিয়ায় অর্থ পাঠাতে চায়, তা হলে শুধু কার্ডের নম্বর ও পিন পাঠিয়ে দিলেও তিনি টাকা তুলতে পারবেন। কার্ডটি যেহেতু নিদির্ষ্ট কারও নামে থাকে না, তাই কে কাকে কোথা থেকে টাকা পাঠাচ্ছে সেটাও জানা যাচ্ছে না। ফলে অর্থপাচার, মাদক ও অস্ত্র বিক্রির অর্থ পরিশোধের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
আজাদ নামে ভার্চুয়াল কার্ডের একজন গ্রাহক আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিদেশি বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনতে তিনি ভার্চুয়াল কার্ড ব্যবহার করেন। কারণ এটা সহজ এবং দ্রুত করা যায়। কয়েক মিনিটে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দিলে ভার্চুয়াল কার্ড পৌঁছে যাচ্ছে। সেই কার্ড দিয়ে আমরা যে কোনো পণ্য কিনতে পারছি। ফেসবুক ও গুগলে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া যাচ্ছে সহজেই। এছাড়া দেশের বাইরে কাউকে টাকা পাঠাতে চাইলেও কার্ডটি ই-মেইল করে পাঠানো যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি অবৈধ কাজের জন্য টাকা পাঠাতে চান পারেন। আবার প্রয়োজনেও পাঠাতে পারেন। কে কোথায় টাকা পাঠালো সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে সময় লাগে, আবার নানা রকম ঝামেলাও আছে। তাই বিশ^ায়নের এই যুগে সহজ ও নিরাপদ পন্থায় বিদেশে অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা না করতে পারলে অবৈধ ভার্চুয়াল কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন ঠেকানো সম্ভব না।’
ভার্চুয়াল কার্ডে অর্থপাচারের ব্যাপারে সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, ভার্চুয়াল কার্ড বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলো বিকাশ, নগদ এবং রকেটের দেশিয় মুদ্রায় অর্থ সংগ্রহ করে। পরে মার্কিন ডলার, ইউরোসহ বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রার ই-মানিতে রূপান্তিত হয়। এই অর্থ তারা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠায়। কিংবা সেই টাকা দেশে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট বিদেশি ব্যাংকে পাঠায়। ফলে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব কার্ডের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অর্থ পাঠানোর পাশাপাশি গেমস কেনা, ফেসবুকে পণ্য বুস্ট করা, সফটওয়্যার কেনা, নেটফিক্স-হইচইসহ বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাবস্ক্রিপশন ও রিনিউ করা যায়। অ্যামাজন কিংবা আলিবাবার মতো ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্যও কেনা যায়।
এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল থেকে গত ৪ নভেম্বর এক চিঠিতে বলা হয়, দারাজ ১১.১১ ক্যাম্পেইনে ১ টাকা গেম ও স্পিন দ্যা হুইল সহযোগিতার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চায়। কিন্তু বিষয়টি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী হওয়ায় বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে নির্দেশ আমলে না নিয়ে ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাওয়ায় দারাজকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শোকজ নোটিশ দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘ক্যাম্পেইন বন্ধ করতে নোটিশ দেওয়ার পরও বন্ধ না করায় আমার বৃহস্পতিবার শোকজ করেছি। তিন দিনের মধ্যে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে।’ এদিকে দারাজের অনুমোদনহীন ভার্চুয়াল পণ্য বিক্রির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
সুত্রঃ আমাদের সময়