দেশে যেনতেনভাবে আর ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না। পণ্য বা সেবা কেনাবেচা, ফেরত ও পরিবর্তনের শর্ত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বা মার্কেটপ্লেসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পণ্য ও সেবা বিক্রি বা প্রসারের জন্য কোনো ধরনের লটারি বা লটারিজাতীয় কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারবে না কোনো প্রতিষ্ঠান। কোন পণ্যের স্টক কত, তা-ও জানাতে হবে গ্রাহকদের।
এসব শর্ত জুড়ে দিয়েই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)-এর আওতায় নির্দেশিকাটি তৈরি করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেল ইতিমধ্যে নির্দেশিকার একটি খসড়া তৈরি করেছে। ই-কমার্স সেলে বর্তমানে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সম্প্রতি শীর্ষ ১০ ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা করেছে। এগুলো হচ্ছে দারাজ ডটকম ডট বিডি, প্রিয়শপ ডটকম, আজকেরডিল ডটকম, রকমারি ডটকম, কিকসা, অথবা ডটকম, পিকাবো ডটকম, বাগডুম ডট, বিক্রয় ডটকম ও ক্লিকবিডি।
ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতা বা গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য নেয়। এ তথ্যের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কী কী ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে, তথ্য কোথায় সংরক্ষিত থাকবে, পরে সেগুলো কোথায় ব্যবহৃত হবে—এসব বিষয়ে ক্রেতাদের পূর্বানুমতি নিতে হবে। ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের বিষয়ের শর্তগুলো ক্রেতারা যে দেখেছেন, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওয়েবসাইটে চেকবক্স থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট তৈরি করা যাবে না এবং ক্রেতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পণ্য কিনতে বাধ্য করা যাবে না।
গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে খসড়ায় পণ্যের স্টক উল্লেখ ও তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করার বাধ্যবাধকতা আরোপের কথা বলা হয়েছে। পণ্য স্টক বা মজুত রাখতে নিজস্ব ওয়্যার হাউস বা গুদামঘর থাকতে হবে।
অন্য বিক্রেতার পণ্য বিক্রি করলে তা কী পরিমাণ আছে, সে অনুযায়ীই ক্রয়াদেশ (অর্ডার) নিতে হবে। তৃতীয় পক্ষের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকতে হবে।
বলা হয়েছে, ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেসে বিক্রয়যোগ্য পণ্য সেবার ওপর আরোপিত সব ধরনের করসহ মূল্য, যথাযথ বিবরণ, পৌঁছানোসহ অন্যান্য খরচের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পণ্যের ক্ষেত্রে ছবি, ভিডিও, রং, আকৃতি, পরিমাপ, ওজন, উপাদান আর সেবার ক্ষেত্রে সেবার ধরন, সেবা দেওয়ার পদ্ধতি ইত্যাদি জানতে দিতে হবে গ্রাহকদের।
যেসব পণ্য বিক্রিতে কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক, তা মানতে হবে। পণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখও জানাতে হবে। কোনো নকল বা ভেজাল পণ্য প্রদর্শন করা যাবে না।
বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে তার নিবন্ধন নম্বর, কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের নিবন্ধন নম্বর এবং ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য নম্বর উল্লেখ করতে হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, পণ্যের মূল্য পরিশোধের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য পৌঁছাতে হবে সরবরাহকারী বা সরবরাহের জন্য নিয়োগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে। ক্রেতাকে তা মোবাইলের খুদে বার্তা (এসএমএস) দিয়েও জানাতে হবে।
ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেওয়া হলে এবং ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরের হলে অগ্রিম নেওয়ার ৫ দিনে, ভিন্ন শহরে থাকলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে।
ক্যাশ অন ডেলিভারি বা আংশিক ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রে ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ৭ দিন এবং ভিন্ন শহরে থাকলে ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মামলা করতে পারবেন ভোক্তা। তখন অধিদপ্তর পণ্যমূল্যের সমান বা দ্বিগুণ জরিমানা আরোপ করতে পারবে।
পণ্য সরবরাহের সময় মুদ্রিত বিল রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আবার যেসব পণ্যের ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি রয়েছে, সরবরাহের সময় সেগুলোর কার্ড ক্রেতাকে দিতে হবে।
অভিযোগ জানানোর জন্য ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা বা অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যম ঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে। ক্রেতারা যাতে সহজে যেকোনো বিষয়ে সহজে যোগাযোগ করতে পারেন, সে জন্য ক্রেতাসংখ্যার আনুপাতিক হারে কাস্টমার কেয়ারে কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। পণ্যের ব্যাপারে রেটিং এবং মতামত জানানোর ব্যবস্থাও রাখতে হবে ওয়েবসাইটে। এতে ভবিষ্যতের ক্রেতারা রেটিং দেখে কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
ক্রেতাদের অভিযোগ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রেকর্ডের ব্যবস্থা রাখা এবং যেকোনো অভিযোগ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান কোনো কারণে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে সাত দিনে ভোক্তার টাকা ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো মাশুল থাকলে তা বহন করবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘ডিজিটাল কমার্স একটি বাস্তবতা। আমরা এর প্রসার চাই। এ জন্য একটি খসড়া করা হয়েছে। খসড়ার ওপর মতামত দিতে আগামী সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে বৈঠক ডাকা হবে।