ঢাকা | শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ |
৩০ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

টেক্সটাইল ও পোষাক শিল্প: টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার-বি এম শরীফ

টেক্সটাইল ও পোষাক শিল্প: টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার-বি এম শরীফ
টেক্সটাইল ও পোষাক শিল্প: টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

আজকের আধুনিক উতপাদনশীল বিশ্বে টেক্সটাইল ও পোষাক শিল্প যে বিষয়গুলো নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তার মধ্যে রয়েছে দক্ষতা, টেকসইত্ব এবং ক্লায়েন্টের চাহিদা অনু্যায়ী দ্রুততার সাথে সাড়া দেয়া। তদুপরি, শিল্প বাস্তুতন্ত্র, বৈশ্বিকভাবে টেকসই ব্যবসায়ের প্রবণতা এবং ভোক্তা-চালিত অর্থনীতি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও উদ্ভাবনী হতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ প্রযুক্তি নির্ভর গ্রাহকরা পরিবেশ সচেতন এবং পরিবেশ বান্ধব পণ্যের জন্য অর্থ খরচ করতে বেশি আগ্রহী।

যার ফলে টেক্সটাইল ও পোষাক শিল্পকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ত্রিমুখি পদ্ধতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে খুবই চতুরতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে। টেক্সটাইল ও পোষাক সংস্থাগুলির পক্ষে কেবলমাত্র সেরা পণ্য এবং সময়মতো সরবরাহ করা নয়, দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

কয়েকটি পরীক্ষামূলক ফলাফল দ্বারা এটা প্রমাণিত যে শিল্প সরঞ্জামে বিনিয়োগের চেয়ে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের ফলে প্রাপ্ত লাভ অনেক বেশি। ট্রিউয়ের মতে, ইন্ডাস্ট্রির ৪.০ শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোকে ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি), রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি), রোবটিকস, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ক্লাউড প্রযুক্তি একীভূত করতে প্ররোচিত করে। উন্নত এবং ব্যয়বহুল প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলো এর মাধ্যমে কাংখিত স্থায়িত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অটোমেশন ও ডিজিটাইশেন হতে প্রাপ্ত বিশাল উপাত্তকে প্রয়োজনীয় তথ্যে রূপান্তর করতে না পারলে টেকসইত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়।

বিশ্ব বাজারে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে উৎপাদন পরিকল্পনা, চাহিদা ও পণ্য বিক্রির পূর্বাভাস, সরবরাহের ধারা পরিচালনা, দ্রুত পণ্য বাজারজাতকরণ এবং ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্টের জন্য এ জাতীয় বিশাল পরিমাণের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।

আধুনিক শিল্প বিপ্লব কয়েকশো বছর ধরে চলেছিল। এখন ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ যুগ শুরু হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ ধারণাটি মূলত ২০১১ সালে জার্মানদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল।

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০এর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হল সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম (সিপিএস)- যার মূল ভূমিকা সক্রিয় এবং গতিশীল উত্পাদন চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করা। পুরো শিল্প ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এ সিপিএস কে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এ এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি), রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি), ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি), ক্লাউড কম্পিউটিং, অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং মেশিন লার্নিং সহ অনেকগুলি প্রযুক্তি এবং সহযোগী সিস্টেম রয়েছে।

স্বয়ংক্রিয় ডেটা এক্সচেঞ্জের উপর ভিত্তি করে পোসাদ এট আল ইন্ডাস্ট্রি 4.0 এর সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ করেছে যেগুলো হল অটোমেশন, ডিজিটাইজেশন, বরাদ্দ, উৎপাদন, অপ্টিমাইজেশন পাশাপাশি কর্পোরেট মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়া এবং যোগাযোগ।

সাম্প্রতিক দশকে আইওটির আবির্ভাব একাধিক প্রযুক্তির মধ্যে আন্তঃসংযোগ সৃষ্টি করে, যার দ্বারা উন্নত পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। আইওটি-তে ফ্যাশন ডিজাইন, উন্নয়ন, উৎপাদন এবং টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে।

আইওটি সেন্সরগুলি শুধুমাত্র কাপড় নয় এর পাশাপাশি কাপড় উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত মেশিনে স্থাপনের মাধ্যমে যন্ত্র ট্র্যাকিং করার কাজে লাগানো যায়। আইওটি টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল এর সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সরবরাহের ধারা দৃশ্যমান করতে গূরুত্বপূর্ণ বাস্তব তথ্যকে সমন্বয় করে।

আইওটির সংযুক্ত ডিভাইসগুলি প্রতিদিন বড় ডেটা সেট তৈরি করে। যা রূপান্তরিত হয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতি আরও ভালভাবে তথ্য বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি সংস্থাকে বিআইএস গ্রহণ করতে পরিচালিত করে।

বিগ ডেটা বলতে ডেটা সেটের ভিন্ন ভিন্ন কাঠামোকে বুঝায়। নব নব প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের ডেটা যেমন কাঠামোবিহীন ডেটা (যেমন, সিমুলেশনস, থ্রি ডি মডেল, চিত্র, পাঠ্য, অডিও এবং ভিডিও), আধা-কাঠামোগত (যেমন, এক্সএমএল), বা কাঠামোগত (যেমন, সংখ্যা, সম্পর্কিত টেবিল, রেকর্ডস), ব্যক্তিগত ডেটা এবং অর্থনৈতিক ডেটা) ইত্যাদি ব্যবহার করতে পরিচালিত করে।

এই ডেটা বিশাল পরিসীমার সেন্সর এবং সোশ্যাল মিডিয়া থেকে উৎপন্ন হয়ে ইন্টারনেটে সঞ্চারিত হয় যা পরবর্তীতে ক্লাউড প্রযুক্তির মাধ্যমে সার্ভারে সঞ্চিত। আরএফআইডি, ক্লাউড প্রযুক্তি, আইওটি এবং মোবাইল কম্পিউটিংয়ের প্রয়োগ সমসাময়িক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ডেটা প্রসেসিং টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল সংস্থাগুলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উন্নত প্রযুক্তির সাথে বিশ্লেষণী সিস্টেমগুলির একীভূতকরণের ব্যবস্থা কর দেয়।

বর্তমানে পোষাক ব্যবসায়ীদের কাছে খুবই পছন্দের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্লকচেইন। কারন তারা খুব সহজেই মুহূর্তের মধ্যেই ফাইবার সরবরাহকারী থেকে শুরু করে উৎপাদক, পরিবহনকারী এমনকি খুচরা বিক্রেতাদে কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন। এছাড়াও ব্যবহৃত কাঁচামাল ও উৎপাদন প্রক্রিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে পণ্যের টেকসইত্ব ট্র্যাক করা যায়। ব্লকচেইন ব্র্যান্ড এবং গ্রাহকদের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে। এখন যে কোন ব্র্যান্ডযুক্ত পণ্যের সত্যতা খুচরা বিক্রেতা এবং গ্রাহক উভয় দ্বারা যাচাই করা যায়। ব্র্যান্ডগুলি বিক্রয় এবং রয়্যালটি প্রদানের উপর নজর রাখতে পারে যার মাধ্যমে নকল পণ্যসমূহ নির্মূল করা সম্ভব। ব্লকচেইন পোশাক শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনছে এবং ভোক্তারা এটা পছন্দও করছেন। সরবরাহ থেকে ডিমান্ড চেইন - ব্লকচেইন এর বিচরণ সর্বত্র।

ব্লকচেইন ভোক্তাদেরকে আরও সচেতন করেছে। এখন একজন ভোক্তা খুব সহজেই পণ্যের ট্যাগ স্ক্যান করে তা সম্পর্কে পুরো তথ্য জেনে নিতে পারেন। প্রযুক্তি কেবলমাত্র পোষাক তৈরি পদ্ধতিই নয় এর গ্রাহক এবং গ্রাহকের ব্যবহারের ধরণও পালটে দিয়ছে। ব্যবসায়িক ধারা এবং শিল্পের সংস্কৃতিতে নতুনত্বই ফ্যাশন ও পোষাক শিল্পের ভবিষ্যত।

এ আই উদ্ভাবনের মাধ্যমে দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন প্রযুক্তি বিকাশের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ আই এর ধারণাটি কিছু মৌলিক ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে যেমন সনাক্তকরণ, পর্যবেক্ষন, পরিদর্শন, গ্রেডিং, পুর্বাভাস ইত্যাদি। সাধারণত এই সমস্ত কাজ ক্লান্তিকর হয়ে থাকে যার ফলে প্রায়শই কর্মীদের কাছ থেকে অস্পষ্ট ফলাফল আসে। বিভিন্ন শ্রেণিবদ্ধ প্রযুক্তির সাহায্যে এ আই, এই মৌলিক কাজগুলোর দক্ষতা ও নির্ভুলতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

টেক্সটাইল প্রযুক্তিতে এআইয়ের প্রয়োগ এখনও ব্যাপক নয়, এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও। তবে নিজেদের টেক্সটাইল সরবরাহ ধারায় বিদ্যমান জটিল সমস্যা নিরূপনে উন্নত দেশ সমূহ বিশেষ করে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রনের সমস্যা বিদ্যমান সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেক্সটাইল শিল্পকে উপকৃত করার মত যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষত্রে আমাদের মত দেশে যেটা ক্ষেয়াল রাখতে হবে যে, এ ধরনের প্রযুক্তি গ্রহন করতে আমরা প্রস্তুত কিনা! আমরা যদি সত্যিই আমাদের শিল্পের ভবিষ্যত সুন্দর করে সাজাতে চাই তাহলে অবশ্যই এই বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হবে এবং আমাদের প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে একসাথে কাজ করতে হবে।

লেখকঃস্কাইলার্ক সফট লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক

টেক্সটাইল,পোষাক শিল্প
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend
Vention