বাংলাদেশে ই-কমার্সের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বয়স ৪৫-এর নিচে। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। সেইসাথে মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা অনলাইনে স্থানান্তরিত করার জন্য দ্রুত প্রযুক্তিকে বরণ করে নিচ্ছে।
ডিজিটাল রূপান্তর উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। সেইসঙ্গে ভোক্তাদের জন্য নানা সুযোগ গ্রহণ সম্ভব করে তুলেছে। তবে আমাদের এখনও অনেক দূর যেতে হবে। বাংলাদেশে ই-কমার্স ধীরে ধীরে একটা কাঠামোর মধ্যে আসছে। কাজেই ভোক্তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টির জন্য শক্তিশালী অবকাঠামো, শক্তিশালী নীতিমালা পরিবেশ এবং টেকসই ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে আমরা অস্থিতিশীল ব্যবসা মডেল এবং প্রতারণামূলক স্কিমের বিস্তার দেখেছি।
ইভ্যালি, ধামাকা শপিং ও আলেশা মার্টের মতো বেশ কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম লোভনীয় 'ক্যাশব্যাক'-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করেছে। বিক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়েছে, বাকিতে পণ্য নিয়েছে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে থেকে। অথচ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এরা কোনো কার্যকর মূলধন সংগ্রহ করেনি।
একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তি, পণ্য, ভৌত অবকাঠামো এবং গ্রাহক টানার প্রয়োজন হয়। আর সেজন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ লাগে। নতুন গ্রাহক টানার জন্য বেশিরভাগ সময়ই আকর্ষণীয় ছাড় দেওয়া হয়। আর বেশি ছাড় মানেই লোকসানে পণ্য বিক্রি করা।
বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারী বাড়ায় অভিজ্ঞ ও যোগ্য বিনিয়োগকারীদের (ভিসি ফান্ড, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, কৌশল) কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী মূলধন সংগ্রহ করে। এ বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা মডেল ও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলোর সঙ্গে পরিচিত।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ প্ল্যাটফর্মগুলো এরকম মূলধন জোগাড় করতে পারেনি। উল্টো এরা স্বল্পমেয়াদী দেনার মাধ্যমে গ্রাহক বাড়িয়েছে। গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের দেনা তাদেরকে কয়েক দিনের মধ্যে না হলেও কয়েক মাসের মধ্যে মেটাতে হবে।
ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, আলেশা মার্টসহ সম্প্রতি চালু হওয়া আরও কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম লাইসেন্সবিহীন ও অনিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল পেমেন্ট ওয়ালেট পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম নির্দেশিকাসহ প্রচলিত আইন ও নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে।
এসব ওয়ালেট ব্যবহার করে এরা সাধারণ মানুষের থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে, ছাড়ের পরিবর্তে ক্যাশব্যাক ব্যালেন্স চালু করে নতুন ধরনের টাকা তৈরি করছে এবং সেই ক্যাশব্যাক ব্যালেন্স কখন ও কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা ঠিক করে দিয়ে অর্থের প্রবাহকে প্রভাবিত করছে। এ কাজ করে এই প্লাটফর্মগুলো তত্ত্বাবধানবিহীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে এবং বস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
এই প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসা মডেলে পঞ্জি স্কিমের সমস্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এদের ব্যবসা মডেল হুবহু মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) মডেলের মতো। এ ধরনের স্কিমগুলোতে মানুষকে (এক্ষেত্রে গ্রাহকদের) অস্বাভাবিক বড় অঙ্কের লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। এবং তাদেরকে যে রিটার্ন দেওয়া হয়, তা আসে আরেকদল মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকা থেকে। ওই দ্বিতীয় দলের গ্রাহকদেরও বিশাল লাভের প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। এভাবে এই চক্র চলতেই থাকে।
নিয়ন্ত্রণ করা না হলে এমএলএম প্রতিষ্ঠানের মতোই পঞ্জি স্কিমও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ওই পর্যায়ে যথেষ্ট টাকা জমলে সেই টাকা নিয়ে ওই পঞ্জি স্কিমের হোতারা উধাও হয়ে যায়।
এখন পর্যন্ত অন্তত এরকম একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে এই ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমরা। প্রতিষ্ঠানটি ধামাকা শপিং। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, কর্তৃপক্ষের সন্দেহ, প্রতিষ্ঠানটি ৫০ কোটি টাকা পাচার করেছে।
এখন করণীয় কী? প্রথমত, আমাদেরকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। 'টাকা' নেই হয়ে গেছে, কারণ কখনও এই টাকার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এটা সাধারণ গণিত, মৌলিক হিসাব। কোম্পানির নেট দায় কোম্পানির মোট লোকসানের সমান।
এই লোকসানগুলো কোথায় হলো? এই লোকসান হয়েছে বিশাল ছাড় ও চড়া বেতন দিয়ে, ক্রীড়া দলের স্পন্সর হয়ে, মিডিয়া কেনায় এবং প্রভাবশালীদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সুবিধা নেওয়ায়। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, এই দায়গুলোর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য।
একটা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা তদন্ত অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির দায়ের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। ওই তদন্তে আরও বলা হয় যে, প্ল্যাটফর্মটি তদন্তে পূর্ণ সহায়তা করেনি। তথ্য প্রদানের অনুরোধ করা হলেও তারা ঠিকমতো তথ্য দেয়নি। তদন্তে বলা হয়, প্ল্যাটফর্মটির প্রকৃত দায়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রকদের অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, আলেশা মার্ট এবং এরকম আরও যেসব প্ল্যাটফর্মের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তাদের কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের প্রধানদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা উচিত।
এত বড় প্ল্যাটফর্ম 'ব্যর্থ হতে পারে না', কিংবা 'মানুষের অর্থ পুনরুদ্ধারে' সাহায্য করার জন্য এদেরকে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক—এরকম বিভ্রান্তিকর ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নীতিনির্ধারকদের উচিত ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থা নেওয়া।
এই প্লাটফর্মগুলো যতক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যায়, ততক্ষণই আর্থিক লোকসানের মধ্যে তা চালায়। এই আর্থিক লোকসানের প্রতিটা টাকা প্রতিষ্ঠাতা বা বিনিয়োগকারীরা নয়, গ্রাহক ও সরবরাহকারীরা বহন করেন। এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দেওয়ার অর্থ হলো, এদের দায়ের পরিমাণ হু হু করতে বাড়তে থাকা।
পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা যে চলছে, তা-ও মেনে নিতে হবে আমাদের। এরকম প্রচেষ্টার একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো ইভ্যালির একটি 'বিনিয়োগ ঘোষণা'। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ওই ঘোষণায় ইভ্যালি দাবি করেছে সবরাহকারীদের কাছে তাদের যে বিশাল দেনা, সেটাকে মূলধন হিসেবে ইকুইটিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও দাবিটি মিথ্যা। আমাদের বুঝতে হবে, এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, গ্রাহকদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে। এই ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে তারা প্রতারণা চালিয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, নীতিমালা বারবার সংশোধন করা উচিত নয়। এমন নীতিমালা করতে হবে, যা ইকোসিস্টেমকে বিকাশিত করতে পারবে। সবশেষে এই নীতিমালার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে যথাক্রমে ডিজিটাল বাণিজ্য নির্দেশিকা ও এসক্রো নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়েছে। কিছু বিধান আছে যেগুলো পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে শিল্পের বিকাশ রোধ না হয়। তাছাড়া বৈধ অপারেটরদের খরচ যেন বেড়ে না যায় এবং তারা যেন নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে, সেজন্যও কিছু বিধান পর্যালোচনার দরকার আছে।
আমরা দেখেছি, প্রতারক প্ল্যাটফর্মগুলো সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন নীতিমালা প্রবর্তনের পরও ইভ্যালি লোভনীয় অফারগুলো দিয়ে যাচ্ছে এবং নীতিমালা অনুযায়ী ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিম অর্থ সংগ্রহ করেছে। তারপর বারবার সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আলেশা মার্ট নীতিমালা লঙ্ঘন করে ৪৫ দিনের অগ্রিম পেমেন্ট সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পাওয়ার পরই কেবল এ ধরনের অফারগুলো প্রত্যাহার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একটি নীতিমালাকে সফল করার জন্য তার ধারাবাহিক প্রয়োগ প্রয়োজন। আমরা ঠিক এ কাজটাই করতে পারছি না।
সবশেষে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এটি শুধু নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব নয়। এই চুরি বন্ধ করার জন্য সরবরাহকারী, পেমেন্ট সংগ্রহকারী, পেমেন্ট পরিষেবা প্রদানকারী, লজিস্টিক পরিষেবা প্রদানকারী, ব্যবসা সমিতি এবং গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
পাওনা আদায় করা যাবে—এ চিন্তা করে সরবরাহকারীদের বাকিতে পণ্য দেওয়া বন্ধ করা উচিত। একদল সরবরাহকারীর পাওনা মেটানো হবে অন্য একদল সরবরাহকারীর কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নিয়ে। পেমেন্ট সংগ্রহকারী ও পেমেন্ট পরিষেবা প্রদানকারীদের উচিত অবিলম্বে প্রশ্নবিদ্ধ প্ল্যাটফর্মগুলোর পেমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া। নইলে প্রতিষ্ঠানগুলো এই পঞ্জি স্কিম চালিয়েই যাবে।
লজিস্টিক পরিষেবা সরবরাহকারীদেরও উচিত এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে সেবা দেওয়া বন্ধ করা। বাজারে শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার জন্য ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনকে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সদস্যপদ স্থগিত করতে হবে। এবং সবশেষে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতায় ভূমিকা রাখতে হবে।
ফাহিম আহমেদ: পাঠাও-এর প্রেসিডেন্ট
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই নিবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্য একান্তই লেখকদের নিজস্ব মতামত। এ নিবন্ধ কোনোভাবেই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়।