ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে সরকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের সুফলও ভোগ করছে জনগণ। এরপরও প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত বাংলাদেশ রেলওয়ে। এখনো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ট্রেনের টিকিট বিক্রি করতে পারছে না সংস্থাটি। ফলে ভোগান্তি বাড়ছে যাত্রীদের। হয়রানি কমাতে সহজ ডটকমের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি শুরু করলে সেখানেও সেবা মিলছে না সহজে।
গত ২৬ মার্চ থেকে অনলাইনে নতুন ব্যবস্থাপনায় সহজ ডটকমের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি শুরু করে রেলওয়ে। কিন্তু অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করায় অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সহজের। অনলাইনে টিকিট বিক্রির শুরুর দিনই অচল হয়ে পড়ে তাদের ওয়েবসাইট। পরে কখনো ফ্রিতে, কখনো ২০ টাকায় ঢাকা-জামালপুর এক্সপ্রেসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের টিকিট প্রাপ্তির মতো ঘটনাও ঘটছে।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, নতুন ই-টিকেটিং ওয়েবসাইটে ওটিপি কোড সময়মতো আসে না। প্রোফাইল এডিট করার সুযোগ নেই। নেই ড্যাশবোর্ড দেখার কোনো ব্যবস্থা। ট্রেনের সময়সূচি দেখার সুবিধা নেই। ভেরিফাইয়ের সিস্টেম নেই কাউন্টার টিকিট। সিট একবার সিলেক্টের পর আনসিলেক্ট করা যায় না। পেমেন্ট সিস্টেমে রকেট, নগদ, ট্যাপ অপশন নেই। পেমেন্ট সফল হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে আসছে না টিকিট। ফলে নতুন এ উদ্যোগ সফল হয়নি বলে মনে করেন যাত্রীরা।
যাত্রীদের অভিযোগ, আগে সিএনএসবিডি নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সারাদেশে ট্রেনের টিকিট বিক্রি করতো। তাদের বিরুদ্ধেও যাত্রী হয়রানির নানা অভিযোগ ছিল। কিন্তু এখন আগের হয়রানির সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে সহজ। বেশিরভাগ সময়ই সহজের সার্ভার ডাউনের কারণে ওয়েবসাইটেই ঢোকা যায় না। স্টেশনে টিকিট কাউন্টারে গিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। অথচ রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে বছরে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার। অবিলম্বে রেলে যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর দাবি তাদের।
তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের দাবি, নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিলে সমস্যা হতেই পারে। তারা দ্রুত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে। রেলে যাত্রীসেবার মানও বাড়বে বলে দাবি তার।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, আগে সিএনএসবিডি প্রতি টিকিটের জন্য রেলের কাছ থেকে দুই টাকা ৯৯ পয়সা করে নিতো। সেখানে সহজ অস্বাভাবিক কম দামে (২৫ পয়সা) টিকিট বিক্রির একটি প্রস্তাব দেয় রেলওয়েকে। পরে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সিএনএস থেকে বেরিয়ে সহজের সঙ্গে টিকেটিং বিষয়ে চুক্তি করে রেলওয়ে। কিন্তু সহজে টিকিট বিক্রির সে সক্ষমতা আছে কি না তা যাচাই করেনি সংস্থাটি।
এর মধ্যে ২৬ মার্চ থেকে সহজের ব্যবস্থাপনায় ট্রেনের অনলাইন টিকিট বিক্রি শুরু হয়। প্রথম দিনই সাইট অচল হয়ে যায়। যারা ঢুকতে পেরেছেন, তারা ওয়েবসাইটের ধীরগতির কারণে পড়েন বিড়ম্বনায়।
রাজধানীর মহাখালীর বাসিন্দা আরমান আলী। গত ৩১ মার্চ অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে কমলাপুর থেকে রাজশাহীর টিকিট কাটার চেষ্টা করেন। কিন্তু যতবারই আসন সিলেক্ট করে টাকা পেমেন্ট করতে চেয়েছেন, ততবারই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। পরে কমলাপুর রেলস্টেশনের কাউন্টারে গিয়েও তিনি নির্দিষ্ট গন্তব্যের টিকিট পাননি। বাধ্য হয়ে বাসে রাজশাহী যেতে হয়েছে তাকে।
ট্রেনে টিকিট কাটার ভোগান্তি নিয়ে কথা বলেন আরমান আলী। তিনি বলেন, নিরাপদ ও আরামদায়ক যাতায়াতে ট্রেন সবারই পছন্দ। কিন্তু ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে যাত্রীদের যে ভোগান্তি পোহাতে হয়, তা বলে বোঝানো যাবে না। এই ভোগান্তি লাঘবে রেলওয়ের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এই সেবাখাতে গুরুত্ব দিতে হবে।
৩০ মার্চ কমলাপুর কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামের টিকিট কাটেন গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা মাসুদ খন্দকার। আলাপকালে তিনি বলেন, আগে সব সময় অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটতাম। কিন্তু সহজকে দায়িত্ব দেওয়ার পর অনলাইনে ঢোকা যায় না। আবার ঢোকা গেলেও ওয়েবসাইট ঠিকমতো কমান্ড নেয় না। এছাড়া বিকাশে টাকা দেওয়া নিয়েও জটিলতা আছে। এসব সমস্যা থাকায় ৮০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে কমলাপুরে এসে টিকিট কাটতে হলো।
মাসুদ খন্দকারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন কমলাপুর রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারগুলোতে শত শত যাত্রীর ভিড়। একটি টিকিট পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের।
আলমগীর হোসেন নামে এক যাত্রী বলেন, অনলাইনে টিকিট কাটার সিস্টেম বুঝি না। তাই সব সময় কাউন্টার থেকে টিকিট নেই। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে স্টেশনে যাত্রীর চাপ বাড়ছে। এতে একটা টিকিট পেতে দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি টিকিটে পৌনে তিন টাকা বাঁচাতে গিয়ে টিকিটের পুরো টাকাটাই গচ্চা যাচ্ছে রেলের। অনেক যাত্রী টাকা ছাড়াই নির্দিষ্ট গন্তব্যে টিকিট পাচ্ছেন। কেউ কম টাকা দিয়ে দূরে যাতায়াত করছেন। আবার কারও টাকা কেটে নিলেও টিকিট পাচ্ছেন না। এর মধ্যে টিকিটের জন্য যাত্রীদের হাহাকার লেগেই আছে। অনলাইনে নিবন্ধন ও টিকিট কাটতে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে।
কমলাপুর রেলস্টেশনের টিকিট বিক্রেতা আবির হোসেন বলেন, এখন টিকিটের ৫০ শতাংশ কাউন্টারে এবং বাকি ৫০ শতাংশ অনলাইনে বিক্রি হয়। কিন্তু অনেকেই অনলাইনে টিকিট কাটতে পারছেন না। তাই কাউন্টারে যাত্রীর চাপ বাড়ছে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যাত্রীদের দুর্ভোগ, বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সহজ ডটকমের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহাত আহমেদ বলেন, ২৬ মার্চ সকাল ৮টায় টিকিট বিক্রি শুরু হলে মিনিটে ২০ থেকে ২২ লাখ হিট পড়তে থাকে ওয়েবসাইটে, যা ছিল অস্বাভাবিক। আমাদের ধারণা, দেশের বাইরে থেকে রেলওয়ের ওয়েবসাইটে হিট আসাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। ফলে দেশের মানুষ টিকিট কাটতে পারেনি। এখন অভিযোগ অনেক কমছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের অভিযোগ আর থাকবে না।
সহজে ট্রেনের অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থাপনার সক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে ফরহাদ আহমেদ বলেন, ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। আমরা ২০১৪ সাল থেকে বাস এবং লঞ্চের টিকিট পরিচালনা করে আসছি। রেলওয়ের ৯০ হাজার টিকিট বরাদ্দ থাকে প্রতিদিন বিক্রির জন্য। যার কয়েকগুণ বেশি টিকিট আমরা বাস ও লঞ্চে প্রতিদিন বিক্রি করি।
সহজে ট্রেনের টিকিট মেলে না ‘সহজ-এ’
জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সহজ ডটকম দীর্ঘদিন ধরে দূরপাল্লার বাসের টিকিট সরবরাহ করলেও তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। হঠাৎ করে তাদের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে ট্রেনের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ট্রেনের টিকিট বিক্রির সক্ষমতাও তাদের নেই। বরং প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেলওয়েই অনলাইন পদ্ধতি চালু করতে পারতো এবং করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় সহজকে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে শুরুতে টিকিট বিক্রি নিয়ে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সব সমস্যা শিগগির সমাধান হয়ে যাবে।
রেলের কোচ দেখতে গত ২৭ মার্চ রাতে তুরস্ক সফরে গেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। এর আগে ১৪ মার্চ সহজ ডটকমের সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তির দিন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, রেলের টিকেটিং ব্যবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যবস্থাটিকে আরও আধুনিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুরোনো প্রতিষ্ঠান থেকে টিকেটিং কার্যক্রম নতুন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। আশা করি এখন থেকে টিকিট কালোবাজারি, টিকিট না পাওয়া এবং যাত্রী হয়রানির অভিযোগ আর থাকবে না।