প্রযুক্তি দুনিয়ার এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত (এআই) চ্যাটবট টুল ‘চ্যাটজিপিটি’। সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এই চ্যাটবটে। অল্প সময়ের মধ্যে এটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে যে প্রতিষ্ঠান, সেই ওপেনএআইয়ে ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট।
তবে ওপেনএআইয়ে এটা মাইক্রোসফটের নতুন বিনিয়োগ নয়, আগেও তার বিনিয়োগ ছিল। কিন্তু চ্যাটজিপিটি বানিয়ে তারা এত সাড়া ফেলে দিয়েছে যে এবার তার সঙ্গে বিদ্যমান অংশীদারত্বের পরিধি আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট। মাইক্রোসফটের এই বিনিয়োগ সম্পর্কে এক ব্লগ পোস্টে ওপেনআই বলেছে, এই বিনিয়োগ তাদের আরও শক্তিশালী, নিরাপদ ও কার্যকর এআই তৈরিতে প্রণোদনা দেবে।
২০১৯ সালে মাইক্রোসফট ওপেনএআইয়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। এর মাত্র সাত বছর আগে স্যাম অ্যাল্টম্যান, ইলন মাস্কসহ কয়েকজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এই ওপেনএআই গড়ে তোলেন। তবে মাইক্রোসফট প্রথমে জানায়নি, ঠিক কত অর্থ তারা সেখানে বিনিয়োগ করেছিল। পরবর্তী সময় এমআইটি টেক রিভিউ নামের একটি অনলাইন সাইটে ২০২০ সালে বলা হয়, মাইক্রোসফট ওপেনএআইয়ে নগদ অর্থ ও তাদের ক্লাউড ব্যবসা অ্যাজিউরের সুবিধা মিলিয়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
গত বছরের নভেম্বর মাসে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে এই ওপেনএআই। তখন ব্যবহারকারীবান্ধব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সফটওয়্যার বা বট ‘চ্যাটজিপিটি’ উন্মুক্ত করে ওপেনএআই। জিপিটি ৩.৫ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের ওপর ভিত্তি করে এই বট তৈরি করা হয়েছে। এই বটের বুদ্ধিমত্তায় মানুষ রীতিমতো চমকে গেছে। প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, বিনিয়োগকারী—সবাই এর প্রশংসায় রীতিমতো পঞ্চমুখ, যদিও চ্যাটজিপিটি এখনো পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। তবে এর মধ্যে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, চ্যাটজিপিটি এখনই যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও উন্নত। ইতিমধ্যে গুগলও নড়েচড়ে বসেছে। এত দিন অন্তর্জালে সার্চ বা অনুসন্ধানের ব্যবসায় তারা একচেটিয়া রাজত্ব করেছে, কিন্তু গত দুই মাসে এই চ্যাটজিপিটি এতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে গুগল একে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে। প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য ইনফরমেশনের তথ্যানুসারে, মাইক্রোসফট তাদের সার্চ ইঞ্জিন বিংয়ের সঙ্গে চ্যাটজিপিটি যুক্ত করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে তারা গুগল সার্চের সঙ্গে টক্কর দিতে সক্ষম হবে—এমনটাই ভাবছে সত্য নাদেলার নেতৃত্বাধীন মাইক্রোসফট। এতে দুই দশক পর গুগলের সার্চ ইঞ্জিন প্রথম কোনো বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কোম্পানি হিসেবে গুগলের বাজারমূল্য ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার। মার্কিন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ডিএ ডেভিডসনের গবেষণা পরিচালক গিল লোরিয়া বলেন, কোম্পানি হিসেবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুগল সার্চ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সার্চ থেকে বার্ষিক ১২০ বিলিয়ন বা ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয় করে গুগল। অন্যদিকে বিং থেকে মাইক্রোসফটের আয় মাত্র ১১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। দীর্ঘ মেয়াদে চ্যাটজিপিটি যুক্ত করলে গুগলকে টক্কর দিতে পারবে বিং।
এদিকে কিছুদিন আগেই মাইক্রোসফট বলেছে, অচিরেই ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা অ্যাজিউরে চ্যাটজিপিটি যুক্ত করবে। এ সেবায় চ্যাটজিপিটি যুক্ত হলে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি এর অ্যাপ ও সেবা ব্যবহার করতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে, ওপেনএআইয়ের সঙ্গে মাইক্রোসফটের এই অংশদারি এআই জগতে মাইক্রোসফটকে শীর্ষ স্থানে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, পাওয়ার পয়েন্ট ও আউটলুকের মতো জনপ্রিয় সব অ্যাপেও চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
২০২০ ও ২০২১ সালে বিপুল মুনাফা করেছিল বিশ্বের বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। কিন্তু ২০২২ সালে পৃথিবী মোটামুটি করোনামুক্ত হয়ে গেলে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমতে শুরু করে। কারণ, তখন মানুষ ঘর থেকে কাজ বাদ দিয়ে আবার কার্যালয়ে ফিরতে শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয়-সংকোচন পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট। শুধু মাইক্রোসফট নয়, আরও অনেক প্রযুক্তি কোম্পানি পাইকারি হারে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। গত সপ্তাহে ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পরই ওপেনএআইয়ে এই বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট।
আগেও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি নামক এই চ্যাটবট তৈরি করেছে। গত ৩০ নভেম্বর থেকে বিনা মূল্যে পরীক্ষার জন্য এটি উন্মুক্ত করা হয়েছে। চ্যাটবট হচ্ছে সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন, যা ব্যবহারকারীর নির্দেশ অনুসারে মানুষের মতো কথোপকথন বা কাজ চালাতে পারে। ওপেনএআই কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের চ্যাটজিপিটি মডেলকে রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক (আরএলএইচএফ) নামের একটি মেশিন লার্নিং কৌশল ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটি সংলাপ অনুকরণ, পাল্টা প্রশ্ন করা, ভুল স্বীকার, এমনকি অনুপযুক্ত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চ্যাটজিপিটির মতো একটি সফটওয়্যার দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন আধেয় তৈরি, গ্রাহক পরিষেবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, কোড ডিবাগসহ নানা কাজে এটি লাগানো যেতে পারে। জানা গেছে, অনেকেই এই চ্যাটবট ব্যবহার করে নিবন্ধ লেখা শুরু করে কবিতা পর্যন্ত লিখছেন।