প্রযুক্তি সেবার প্রাণ বলা যায় ডেভেলপারদের। তারা সেবাগুলোকে সচল রাখতে, সেগুলো উন্নত করতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভুল হবে এবং সেটা থেকে আরও শিক্ষা নিয়ে নিজেদের উন্নত করার পরামর্শ দিয়েছেন খাতটির কর্মীরা।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার খাতের জাতীয় বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) আয়োজিত ১৭তম ‘বেসিস সফটএক্সপো ২০২৩’ আয়োজনে ডেভেলপার সম্মেলনে এমন বিভিন্ন দিক তুলে আনেন আলোচক ও অংশগ্রহণকারীরা।
আজ শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে এক্সপোর তৃতীয় দিনে বিগ শো হিসেবে এই ডেভেলপার কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশের তরুণ সফটওয়্যার ডেভেলপারদের অনুপ্রাণিত করতে এবং তাদের কাজ করার সময় যেসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, সেগুলো নিয়ে সম্মেলনটিতে আলোচনা হয়। তরুণ ডেভেলপারদের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেন দেশের শীর্ষ নামিদামি সফটওয়্যার ডেভেলপারস প্রতিষ্ঠানের সফল প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার প্রফেশনালরা।
সৈয়দা জারা জেরিনের সঞ্চালনায় সম্মেলনটিতে বক্তা হিসেবে ছিলেন মাইমকাস্টের সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সুমন মোল্লা সেলিম, জেলফের হেড অব ইঞ্জিনিয়ার আনাম আহমেদ, ফাসসেটের সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সাব্বির আহমেদ, প্রাভা হেলথের হেড অব ডেটা ফারহাদ নাঈম, যান্ত্রিকের টিম লিড শুভ্র পাল, অ্যানালাইজেনের প্রতিষ্ঠাতা সুমিত সাহা, ব্রেইন স্টেশন ২৩’র লিড ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড সল্যুশন আর্কিটেক্ট আনোয়ার হোসেন এবং অপ্টিমিজেলির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তাজরিয়ান বিনতে জাহিদ।
যান্ত্রিকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের টিম লিডার শুভ্র পাল কথা বলেন এআই নিয়ে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এআই বলা হচ্ছে চ্যাটজিপিটিকে। চ্যাটজিপিটি কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা ব্যবহার করেছেন তারা বুঝতে পারবেন এটি কীভাবে কাজ করছে। একটা বিষয় খেয়াল করবেন, প্রথমবার তাকে যে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, সেটার হয়তো শতভাগ সম্পর্কিত কিছু জানাতে পারে না। কিন্তু পরেরবার যদি তাকে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় তাহলে দেখা যায় আরও বেশি উত্তর দিতে পারে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে সে সম্পর্কে ইন্টারনেটে যত ফ্রুটপ্রিন্ট রয়েছে, তার প্রায় সবই তাকে শেখানো হয়। ফলে তার ক্ষেত্রে সেটি পরে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।’
এছাড়াও আলোচনায় তিনি চ্যাটজিপিটি বিবর্তনের ধারায় কীভাবে আজকের পর্যায়ে এসেছে, যেমন প্রযুক্তিটির প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে কীভাবে ডেভেলপ করা হয়েছে, কোন কোডিং ব্যবহার করা হয়েছে, কি কি সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে, এসব বিষয়ে তুলে ধরেন।
কীভাবে একটি ওয়েব প্রজেক্ট সফল করা যায় তা নিয়ে কথা বলেন ফাসসেটের সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, ওয়েব ডেভেলপের ক্ষেত্রে আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আমরা কী করতে চাই সেটির উপর। সেজন্য আমাদের অপারেশন কমপ্লেক্সটিসিটি কমাতে হবে। আমাদের নতুনদের হায়ার করার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে তাদের ইনোভেটিভ আইডিয়াগুলোকে আমাদের খুব ভালোভাবে গ্রহণ করা উচিত। কেননা ইনোভেশন কিন্তু ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ টুল। এপিআই, ইন্টারফেসসহ কীভাবে আমরা প্রজেক্ট করবো সেগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
সাব্বির আহমেদ বলেন, একটা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি। যেমন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করা, টিমের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, মানসিক প্রশান্তি, যোগাযোগ ইত্যাদি। সেসাথে তিনি একটা স্কেলেবল প্রজেক্ট সফলভাবে বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও কৌশল, ল্যাঙ্গুয়েজ, বিভিন্ন সল্যুশনস নিয়ে আলোচনা করেন।
‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার অটোমেশন ইউজিং সিআই/সিডি টুলস’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন মাইমকাস্ট-এর সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সুমন মোল্লা সেলিম। নিজের দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা স্কেলেবল সল্যুশনস সিস্টেম কীভাবে ডেভেলপ করতে হয়, ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি, কী ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হয় এসব বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন সিনিয়র এই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। উপস্থাপনায় তিনি একটা সফটওয়্যার অটোমেশন সার্ভিস ডেভেলপ করার শুরু থেকে আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন।
ব্রেইন স্টেশন ২৩-এর লিড ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড সল্যুশনস আর্কিটেক্ট আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের ডেভেলপাররা বিভিন্ন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করে থাকি। এর বিশেষ একটি দিক হলো এর সিকিউরিটি। সফফওয়্যারে একটা কোম্পানির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন সংরক্ষণ করে থাকে। এটার জন্য কোম্পানি এমন একটিা সফটওয়্যার নিতে চায় যেখানে তার ইনফরমেশনগুলো সিকিউ থাকবে। তাই যেকোন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করার সময় এর সিকিউরিটি বিষয়টা বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
উপস্থাপনায় ডেভেলপারদের একটা সফটওয়্যার ডেভেলপ করার সময় এর সিকিউরিটি লেভেল কেমন হবে, কতটা সিকিউর হবে, পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর এটি কতটা সিকিউর হলো, এটা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলো কিনা, কি কি কোডিং ব্যবহার করতে হবে, টেস্টিং করার কৌশল, এর জন্য বিভিন্ন টুলস ব্যবহার, ম্যানেজমেন্ট এসব বিষয়ে তুলে ধরেন।একটা সফটওয়্যার ডেভেলপ এবং সেটি অনলাইন প্লাটফর্মে প্রকাশ করার সময় একজন ডেভেলপার কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে থাকে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেন রেডডট ডিজিটাল আইটি লিমিটেডের প্রিন্সিপাল ডেভেলপার অপারেশন আর্কিটেক্ট মো. বাকিবুল হাসান। এরপর তিনি কুবারনেটস প্লাটফর্ম, এই বিজনেস, সুবিধা-অসুবিধা, চ্যালেঞ্জ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেন।
ডেটা নিয়ে কথা বলেন আরেক ডেভেলপার ও প্রাভা হেলথের হেড অব ডেটা ফারহাদ নাঈম। তিনি অর্গানাইজেশনের ডেটার প্রয়োজনীয়তা, তার সংরক্ষণ, ডেটার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। একটি প্রেজেন্টেশনের সাহায্যে তিনি বর্তমান সময়ের ডেটা মডেল, ডেটার ব্যবহার তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ডেটা নিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়, ডেটা ওয়্যারহাউসে নিরাপত্তা এবং ডেটার সুরক্ষা। এ বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হয়।
অপ্টিমিজেলির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তাজরিয়ান বিনতে জাহিদ ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেলের বিস্তারিত কথা বলেন। ক্লায়েন্টসহ অন্যদের চাহিদা রক্ষায় আমাদের সঠিকভাবে তাদের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করতে হবে। আমাদের যা প্রয়োজন সেটা বোঝানো এবং যেটা প্রয়োজন নয় সেটা এগড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু এখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ক্লায়েন্ট কী চায়।
কোড রিভিউ করার ক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখতে হবে কেউ যদি কোড রিভিউ করে তবে সেটা শুধু আমাকে সাহায্য করছে না। আমাদের পুরো টিমকে সহায়তা করছে। এমনকি আমরা কখনোই বলবো না, আপনার ওই কোড ঠিক হয়নি। বরং আমরা বলতে পারি, এটা কী এভাবে করা যায় কিনা। এটা খুবই প্রয়োজন। কোড যারা লেখেন তাদের ক্ষেত্রে ফিডব্যাক খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সহজে কেউ ফিডব্যাক দেয় না। কিন্তু ক্রিটিকেল ফিডব্যাক আমাদের জন্য খুবই গুরুত্ব বহন করে। সেটা থেকে আমরা আরও উত্তরণ করতে পারি।
তরুণ সফটওয়্যার ডেভেলপারদের বিভিন্ন ‘প্রবলেম সলভিং’ বিষয় নিয়ে কথা বলেন জেলফের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান আনাম আহমেদ। উপস্থাপনায় তিনি রেগুলার এক্সপ্রেশন কী, কীভাবে এটা কোডিং করতে হয়, কোন ল্যাঙ্গুয়েজে এটা করলে সুন্দর ও ভাল দেখাবে, কী ধরনের টুলস ব্যবহার করতে হয় এসব বিষয়ে তুলে ধরেন।
তরুণ ডেভেলপারদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন লার্ন উইথ সুমিথ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমিত সাহা। বক্তব্যে নিজের ডেভেলপার হয়ে উঠার বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াই পেরোনোর কথা তুলে ধরেন। একজন তরুণ ডেভেলপার কীভাবে একটা সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ করবে, কী পদ্ধতিতে ডেভেলপ করবে, কোন ল্যাঙ্গুয়েজ, টুলস ব্যবহার করবে এসব বিষয়ে তিনি তার উপস্থাপনায় উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, যেকোন কাজ করতে গেলে ব্যর্থতা আসবে। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। শেখার নেশা থাকতে হবে। জ্ঞানের পিপাসা ও ইচ্ছেশক্তি যার যতবেশি আছে সে কাজে জিতবেই।
সেমিনার শেষে তরুণ ডেভেলপারদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেন ডিভাইন আইটি লিমিটেডের-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ ফকরুল হাসান রাসেল।
চারদিনব্যাপী বেসিস সফটএক্সপো ২০২৩ চলবে আগামী রবিবার পর্যন্ত। সব ধরনের দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকছে এই আয়োজন। দর্শনার্থীরা যাতে সহজেই বেসিস সফটএক্সপোতে যাতায়াত করতে পারেন সেজন্য বিশেষ শাটল বাস সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া রয়েছে গেমিং জোন, বিজনেস লাউঞ্জ, ফুড কোর্ট ও কনসার্ট।
এবারের বেসিস সফটএক্সপোর প্ল্যাটিনাম স্পন্সর হিসেবে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড। গোল্ড স্পন্সর হিসেবে রয়েছে হুয়াওয়ে। সিলভার স্পন্সর হিসেবে রয়েছে রবি, পাঠাও এবং ফাইবার অ্যাট হোম। এছাড়া ফাইভজি পার্টনার হিসেবে রয়েছে গ্রামীণফোন।
আইসিটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (আইবিপিসি) এর সহযোগিতায় আয়োজিত এবারের বেসিস সফটএক্সপোর পেমেন্ট পার্টনার হিসেবে বিকাশ, ইন্টারনেট পার্টনার হিসেবে আমরা নেটওয়ার্কস লিমিটেড এবং অ্যাসোসিয়েট পার্টনার হিসেবে রয়েছে দারাজ, বিডিজবস ডটকম ও ই-কুরিয়ার।
এবারের বেসিস সফটএক্সপো প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। আগ্রহীরা বেসিস সফটএক্সপোর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট (https://softexpo.com.bd/) থেকে বিনামূল্যে নিবন্ধন করে প্রদর্শনীতে অংশ নিতে পারবেন।