অনলাইনে প্রতারণার মাধ্যমে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করেছে যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলোর একটি রিং আইডি। দেড় বছর আগে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা গ্রাহকদের ৩০২ কোটি টাকা অন্যত্র সরিয়ে নেন। তার মধ্যে ৩৭ কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু তদন্ত শেষে এই মামলায় রিং আইডির তিন শীর্ষ কর্তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে সিআইডি।
ঢাকার আদালতে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে রিং আইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শরিফুল ইসলাম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও তাঁর স্ত্রী আইরিন ইসলাম এবং পরিচালক ও শরিফুলের ভাই সাইফুল ইসলামকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে সিআইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়, রিং আইডির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ আদায়, আত্মসাৎ, অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকা স্থানান্তর এবং বিদেশে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়নি। যে তথ্যের ভিত্তিতে মামলাটি করা হয়েছিল, তা ছিল ভুল।
সিআইডির এই প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। তাঁরা বলছেন, সাধারণত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হয় প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। রিং আইডির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে সংস্থা মামলা করেছে, তারাই আবার বলছে অভিযোগ সঠিক নয়। সে কারণে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করা জরুরি।
সিআইডি এ ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করেছিল বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্যের ভিত্তিতে। রিং আইডির ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন ‘বাস্তবসম্মত না হওয়ায়’ সিআইডিকে অনুসন্ধান করতে বলেছিল বিএফআইইউ।
এক বছর অনুসন্ধানের পর ২০২২ সালের আগস্টে রাজধানীর গুলশান থানায় রিং আইডির ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করে সিআইডি। তখন সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে দিনে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করার চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয় রিং আইডি। তাদের ৫টি ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৭৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির ৫টি ব্যাংক হিসাব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই অর্থের মধ্যে ৩৭ কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাৎ করা হয়, যার ৩৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়।
২০২১ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির তৎকালীন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান জানান, সিআইডির অনুরোধে রিং আইডির প্রায় ২০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক জব্দ করেছে। তাদের আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ আরও বেশি।
যা বললেন সিআইডি কর্মকর্তারা
সিআইডি মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় রিং আইডির কর্মকর্তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় গত ১৯ নভেম্বর। সম্প্রতি এ বিষয়ে সিআইডির প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়ার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তখন তিনি এই প্রতিবেদকের সামনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামানকে ফোন করেন। এ সময় মনিরুজ্জামান বলেন, রিং আইডি গ্রাহকদের কোনো টাকা হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করেনি। তাই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বিএফআইইউ থেকে পাওয়া তথ্য ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করা হয়েছিল। মামলাটি শুরু থেকে তদন্ত করেছিলেন সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মীর কাশেম আলী। তথ্য পাচারের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে বলেন। মীর কাশেম রাজি না হওয়ায় তাঁকে লক্ষ্মীপুরে বদলি করা হয়। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য একাধিকবার ফোন করে এবং এসএমএস দিয়েও মীর কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
সিআইডির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, রিং আইডির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ভাটারা থানায় আরেকটি মামলা করে সিআইডি। ওই মামলায় রিং আইডির তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
যেভাবে প্রতারণা করে রিং আইডি
সিআইডি সূত্র জানায়, শরিফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলাম কানাডায় থাকেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের ছেলে শরিফুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেন। ২০০৫-০৬ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তিনি কানাডায় চলে যান। সেখানে আইরিন ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং পরে বিয়ে হয়।
শরিফুল ও আইরিন দম্পতি টেলিযোগাযোগ খাতে ভিশনটেল ও ক্লাউডটেল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করতেন। ২০১৪ সালে এ দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৯৬ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ আনে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি। এ-সংক্রান্ত মামলায় ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁদের। পরে ওই বছরই রিং আইডি চালু করেন শরিফুল। নিজে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে স্ত্রীকে করেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর ভাই সাইফুলকে করেন পরিচালক। রিং আইডির গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের খবর প্রকাশের পর ২০২১ সালে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করেছিল সিআইডি।
অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, রিং আইডির কর্মকর্তারা ব্যবসার আড়ালে অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) করতেন। অল্প সময়ে বেশি আয় ও বেশি কমিশন দেওয়ার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিতেন তাঁরা। রিং আইডির দৃশ্যমান কোনো আয় ছিল না। তাঁরা অল্পসংখ্যক গ্রাহককে কিছু টাকা ফেরত দিলেও তা ফেরত দিয়েছে গ্রাহকদের টাকা থেকে। পরিশোধের এ পদ্ধতি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা পঞ্জি স্কিমের মতো। এমএলএম ব্যবসা পরিচালনায় নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাঁরা নেননি।
রিং আইডি ‘কমিউনিটি জব’ নামে প্রতারণার একটি বিশেষ ফাঁদ তৈরি করেছিল। গ্রাহকদের তারা সিলভার আইডি, গোল্ড আইডি, প্রবাসী গোল্ড আইডি ও প্রবাসী প্লাটিনাম আইডি খুলতে উদ্বুদ্ধ করত। এসব আইডি খুলতে গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠানটিতে ১২ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। পরিচয়পত্রধারীরা ভিপিএনের মাধ্যমে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখতেন, তার বিনিময়ে লাভ পেতেন। বিদেশি যে বিজ্ঞাপনগুলো গ্রাহকেরা দেখতেন, তার জন্য পাওয়া টাকা আর দেশে আসেনি বলে সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন।
রিং আইডির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়াকে অস্বাভাবিক বলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধানের পর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করা হয়। সেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়াটা স্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে আদালত চাইলে মামলাটি পুনঃ তদন্তের জন্য দিতে পারেন।