নিজেদের কনটেন্টকে উন্নত করতে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক বিভিন্ন ফিচারকে সাদরে গ্রহণ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সাররা। তবে তাদেরকেই এখন এআই দিয়ে তৈরি ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও ইউটিউবের মডেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে।
এ রকম এআই দিয়ে তৈরি এক কৃত্রিম মডেল হলো—গোলাপি চুলের আইতানা লোপেজ। কখনো অন্তর্বাস, কখনো সুইমস্যুট বা কখনো জিমের পোশাকে এই মডেলকে ইনস্টাগ্রামের পোস্টের বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়। এই মডেলের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ অনুসারী রয়েছে। তার ইনস্টাগ্রামের বায়তে লেখা ‘গেমার এট হার্ট’ (মনে থেকে একজন গেমার) ও ‘ফিটনেস লাভার’ (ফিট থাকতে পছন্দ করে)। তবে এগুলো সবই কৃত্রিম ও সত্য নয়। যা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হন।
বার্সেলোনা-ভিত্তিক কোম্পানি ‘দ্য ক্লুলেস’ আইতানাকে তৈরি করে। এই কোম্পানি নিজেদের ‘এআই মডেলিং এজেন্সি’ হিসেবে পরিচয় দেয়। কোম্পানিটি ‘ইনফ্লুয়েনসারদের জগৎকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার লক্ষ্যে’ পরিচালিত হয়।
কোম্পানির সৃষ্টির পেছনে একটি কারণ দ্য ক্লুলেসের প্রজেক্ট ম্যানেজার সোফিয়া নোভালেস বলেন, ‘মানব ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে কাজ করার জন্য খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভার্চুয়াল মডেল একটি অর্থনৈতিক বিকল্প উপস্থাপন করে।’
এসব ডিজিটাল মডেল ব্যবহার করার আরেকটি সুবিধা হলো এগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সোফিয়া বলেন, এসব মডেল ব্যবহারের মাধ্যমে সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কোনো শারীরিক ফটোশুটের প্রয়োজন ছাড়াই চিত্র, ফ্যাশন ও নান্দনিকতার বিষয়ে নির্বিঘ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
তবে এআইয়ের উত্থান ডিপফেক ভিডিওগুলো বিস্তার সম্পর্কে উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলছে। এসব ভিডিও খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গত শুক্রবার ফেসবুকের ও ইনস্টাগ্রামের মূল কোম্পানি মেটা বলে, আগামী মে মাস থেকে ‘এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওগুলোর সঙ্গে লেবেল যুক্ত থাকবে।’
কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য বিশাল ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে এআই। অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চ অনুসারে, ইনফ্লুয়েন্সার বাজার আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই বাজার ২০২২ সালে ১ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে ২০ হাজার কোটি ডলার হতে পারে।
ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার ব্যবহার করা নতুন কোনো ধারণা নয়। বার্বির পুতুলের আদলে এআই মডেলের ইতিমধ্যেই ইনস্টাগ্রামে লাখ লাখ অনুসারী রয়েছে।
কিন্তু এসব কৃত্রিম মডেল এখন বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো—এসব কৃত্রিম মডেলগুলো একদম বাস্তব বলে মনে হয়।
২০১৬ সালে ‘লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাসকারী ১৯ বছর বয়সী রোবট’ লিল মিকেলাকে তৈরি করে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কোম্পানি। এই মডেলের ইনস্টাগ্রামে ২৬ লাখ ও টিকটকে ৩৫ লাখ অনুসারী রয়েছে। বিএমডাব্লুর মতো বড় কোম্পানির প্রচারও করেছে লিল মিকেলা।
এএফপিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এই মডেল ব্যবহার করার কারণ তুলে ধরে জার্মানির এই গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি। কোম্পানিটি বলে, ধারণাটি ছিল ‘এমন কিছু তৈরি করা যা আগে কখনো দেখা যায়নি’।
প্যারিস-ভিত্তিক ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি সংস্থা এডি ক্রু-এর প্রধান মাউড লেজিউন বলেন, ‘জনসাধারণের পক্ষে এআই ইনফ্লুয়েন্সারদের গ্রহণ করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। এটি অনেকটা টিভি অভিনেতাদের মতো। আমরা জানি এগুলো বাস্তব নয় ও তাও এসবের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে। এসব ছোট সিরিজ দেখার মতো অভিজ্ঞতা দেয়।’
এডি ক্রু ৩০ টিরও বেশি ইনফ্লুয়েন্সার তৈরি করেছেন। দুই বছর আগে লেজিউন তার নিজস্ব ভার্চুয়াল মেটাগায়া তৈরি করেন।
তবে লেজিউন স্বীকার করেন যে, মেটাগায়া খুব ভালো মতো তৈরি করা হয়নি। তিনি বলেন, এসব উন্নত নকশার তৈরি করার জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তি সেসময় ছিল না। প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব মডেলগুলো সাজাতে হয়, ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য ছবি তুলতে হয় ও একটি গল্প তৈরি কর হয়।
মানব ইনফ্লুয়েন্সাররাও আরও ভালো ভিডিও তৈরির জন্য এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যেমন: ফ্রান্সের চার্লস স্টার্লিংস এআই ব্যবহার করে উন্নত অনুবাদ করার একটি সুযোগ দেখছেন। তিনি হেইজেন ও রাস্ক ডট এআই–এর মত প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলো ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ভিডিওতে ঠোঁট নড়ানো মিলিয়ে দেন।
স্টার্লিংস ডিপশট নামের প্ল্যাটফর্মও ব্যবহার করে। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের বাস্তব ভিডিওতে মানুষের মুখের গতিবিধি ও শব্দ পরিবর্তন করে ডিপফেক তৈরি করতে দেয়। তিনি বলেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ডিপফেক তৈরি করতে তার মাত্র কয়েক মিনিটি সময় লেগেছিল।
তবে চার্লস এই প্রযুক্তিকে প্রয়োজনীয় টুল হিসেবে দেখার পাশাপাশি একে প্রতিযোগী হিসেবেও দেখছেন। তিনি বলেন, কারও কাছে ফোন থাকলেই সে একজন ইনফ্লুয়েন্সার হতে পারে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ইনফ্লুয়েন্সারকে ২৪ ঘণ্টাই পাওয়া যাবে।
মাউড লেজিউনের মতে, ইনফ্লুয়েন্সারদের আরও বেশি কনটেন্ট তৈরিতে সাহায্য করবে এআই।
তিনি বলেন, নিজেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্যামেরার সামনে রাখা কঠিন ও কিছু নির্মাতারা এর ফলে ক্লান্ত হয়ে পরেন। তাই নিজেকে ক্যামেরার সামনে না এনে এআইয়ের মাধ্যমে নতুন উপায়ে কনটেন্ট তৈরি করা যেতে পারে।
এআই মডেলগুলি প্রকৃত ইনফ্লুয়েন্সারদের কাছ থেকে ব্যবসা কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে ক্লুলেস কোম্পানির কোনো দ্বিধা নেই।
নোভালেস বলেন, ‘অপ্রচলিত বা আইটানার মতো এআইভিত্তিক মডেল দিয়ে ‘বাস্তবের ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রতিস্থাপিত হওয়ার কোনো আশঙ্কা আমরা লক্ষ করি না।’ ‘আমাদের দৃষ্টিতে এগুলো শিল্পের আরেকটি প্রতিযোগিতা হিসেবে সহাবস্থান করতে পারে।’