১৫ বছরের স্বৈরশাসনের প্রতিটি সেক্টরকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য খুনি হাসিনার দোসররা সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। এর মধ্যে, আইসিটি সেক্টরকে হরিলুটের কারখানায় পরিণত করেছে সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এর গ্যাং। নারী উদ্যোক্তা বানানোর নাম করে, পলক গ্যাং-এর সহায়তায় সাধারণ নারীদের কাছ থেকে নাসিমা আক্তার নিশা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আজকের এই প্রতিবেদনে, কিভাবে নিশা এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন, তা বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
নাসিমা আক্তার নিশা, একজন সাধারণ মেয়ে, ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদকে ভালবেসে বিয়ে করেন। ফয়সালের গার্মেন্টস ব্যবসায় ভালভাবেই সংসার কাটাচ্ছিলেন নিশা। এ সময়, তিনি এবং আছিয়া নীলা একসঙ্গে কাজ করছিলেন। ২০১৬ সালে আছিয়া নীলা “উইমেন ইন ডিজিটাল” নামে কাজ শুরু করেন এবং নীলার পথ অনুসরণ করে ২০১৭ সালে নিশা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন “উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)”। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। কিন্তু করোনাকালে নিশার স্বামী ফয়সাল আহমেদ মারা গেলে, নিশা কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হন। কিন্তু ফয়সালের অকাল প্রয়াণ যেন তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।
আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পেতে তিনি ধীরে ধীরে “এলআইসিটি” প্রকল্পের পলিসি অ্যাডভাইজর সামি আহমেদ এবং ফিফো টেকের সিইও তৌহিদ হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। এদের মাধ্যমেই নিশা পলকের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ হন। পলক ও তার গ্যাং নিশাকে বুঝিয়ে দেয়, কাজ পেতে হলে তাকে বিশেষ কিছু করতে হবে। নিশা সেই কাজ করতেও রাজি হন—ব্যক্তিগত স্বার্থে নারীদের সরবরাহের কাজ শুরু করেন।
এভাবে পলক ও তার গ্যাং হতাশ করে না নিশাকে। ততদিনে নিশার ফেসবুক গ্রুপ “উইমেন এন্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট” এর প্রায় ১২ লাখ সদস্য। পলক “উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)” কে রেজিস্টার্ড ট্রাস্ট করেন যাতে সাধারণ নারীরা সহজেই এটি বিশ্বাস করতে পারে। এই পেজের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের নামে অনেক টাকা হাতিয়ে নেন নিশা। “উই” এর অ্যাডভাইজর হিসেবে কবির সাকিব ও ভারতীয় সৌম্য বসুকে নিয়োগ করা হয়। সৌম্য বসুকে গ্লোবাল অ্যাডভাইজরের তকমা দিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের (Entrepreneur Masterclass) নামে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। ভুক্তভোগী নারী উদ্যোক্তারা এসব প্রোগ্রামকে প্রতারণা বলে উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া, ট্রেড লাইসেন্স, ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়ার নামেও অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নিশা। পাশাপাশি, নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন পণ্য বিদেশি (মালয়েশিয়া, ইউকে, সিঙ্গাপুর) ফেয়ারে প্রমোটের নাম করে প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করা হয়। পলকের আশীর্বাদে নিশা ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সদস্য হন। এর ফলে আইসিটি বিভাগের সব প্রোগ্রামে নিশা ও WE বেসিসের মতো স্থায়ী অংশীদার হয়ে ওঠে।
নিশা-ফয়সালের বিয়ের উকিল বাবা ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ। তাঁর নাম ব্যবহার করেও অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন নিশা। গুঞ্জন আছে যে, ওবায়দুল কাদেরের কাছেও নিশার যাতায়াত ছিল। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে তার প্রতারণার সহযোগীদের নাম স্বীকার করেছেন।
নিশার “Export Incubator” নামে একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল, যেখানে সদস্য হতে প্রতিজনকে ১৫০০ টাকা দিতে হতো। পরবর্তীতে ২০০০ কোম্পানির এসেসমেন্টের জন্য আরও টাকা নেওয়া হয়। গ্রুপে মেম্বার সংখ্যা ১৭ লাখের মতো, ফলে কত টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়।
কিছু ভুক্তভোগী জানান, “মাস্টার ক্লাস” সিরিজটি LICT এবং ICT-র সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছে। এর ব্যানারে ছিল “Supported by ICT, HI-TECH PARK”। আমরা LICT, ICT ব্যানারে “মাস্টার ক্লাস” সিরিজ-১ (১২টি ক্লাস), সিরিজ-২ (১২টি ক্লাস), এবং অ্যাডভান্স সিরিজ (১২টি ক্লাস) করেছি। এরপর, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের থেকে প্রতিটি ক্লাসের জন্য টাকা নেওয়া হয় (৮০০/১০০০ × ৬১০ × ৩৬টি ক্লাস)। যদি আগে জানতাম যে এই “মাস্টার ক্লাস” সরকারি সহযোগিতায় হতো, তাহলে আমি একটি টাকাও দিতাম না এবং ক্লাস নিয়ে এত পোস্টও দিতাম না।
আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় ২০০০ স্মার্ট নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে অনুদান প্রদান করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। সেখানে “উই” প্রায় ১২০০ জনের উপরে পেয়েছে। “WiFi Bangladesh” (যেখানে ৮০% “উই” থেকে প্রশিক্ষণ করেছে এমন উদ্যোক্তা), “আনন্দ মেলা,” “সর্বজয়া,” “গল্প বলা ফাউন্ডেশন” ইত্যাদি আরও গ্রুপ রয়েছে।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় কেন শুধুমাত্র “উই” এবং নাসিমা আক্তার নিশা এতোগুলো অনুদান পান? কেন সরকারি আইসিটি মন্ত্রণালয় “উই মাস্টার ক্লাসের” জন্য বিল প্রদান করে? একটি ট্রাস্ট বা গ্রুপের সামিট, কালার ফেস্ট অনুষ্ঠানে কেন বিনামূল্যে ভেন্যু ও বিভিন্ন সরকারি সাপোর্ট পাওয়া যায়? সারাদেশে আরও অনেক গ্রুপ, অ্যাসোসিয়েশন, এবং চেম্বার রয়েছে, তবে চট্টগ্রামের মতো বাণিজ্যিক রাজধানী থেকে কয়জন উদ্যোক্তা অনুদান পেয়েছে?
সরকারি অনুদান পেতে হলে উদ্যোক্তাদেরকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ করতে হয়। “উই” এর অনুদান পেতে হলে:
৩০৬০ টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইবার হতে হবে এবং প্রতি বছর ২০০০ টাকা দিয়ে রিনিউ করতে হবে।
৬১০ টাকা দিয়ে নিয়মিত মাস্টার ক্লাসে অংশ নিতে হয়, যদিও এই ক্লাসগুলো এলআইসিটি প্রজেক্টের আওতায় হয়।
যারা সামিট, কালার ফেস্ট, বা অফলাইন মিটআপে অংশগ্রহণ করেন, তাদেরকে অনুদান পাওয়ার জন্য যোগ্য মনে করা হয় এবং তাদেরকে বিভিন্ন কাগজপত্র প্রস্তুত করতে সহায়তা করা হয়।
সরকারি অনুদান পেয়ে কি শান্তি আছে? ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ১৩ হাজার টাকা তারা ওয়েবসাইট তৈরির নামে কেটে রাখে। এরপর কো-অর্ডিনেটররা বলেন, “আপনি অনুদান পেয়েছেন, এবার ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সামিট বা কালার ফেস্ট অনুষ্ঠানে স্পনসর হন বা ১৫-২০ হাজার টাকায় অনুষ্ঠানে স্টল দিন।” উদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হয়।সরকারি অনুদান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য হলেও, যদি সেই টাকাগুলি গ্রুপের অনুষ্ঠানে খরচ হয়, তাহলে ঐ উদ্যোক্তারা কিভাবে এগিয়ে যাবে? গ্রুপের মডারেটর, কো-অর্ডিনেটর, জেলা প্রতিনিধি, এবং বিভাগের প্রতিনিধিদের দাম্ভিক এবং আক্রমণাত্মক আচরণে অনেক উদ্যোক্তা ভুক্তভোগী।
১২০০ উদ্যোক্তার সরকারি আইসিটি অনুদান ছিল ৫০ হাজার টাকা। ওয়েবসাইট তৈরির নামে তারা ১৩ হাজার টাকা কেটে রেখেছে, এবং এই অর্থ দিয়ে ১২০০ উদ্যোক্তাকে একটি করে ওয়েবসাইট পেজ দিয়েছে। এতে তাদের কোনো উপকার হয়নি।
যেহেতু এই প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট, তাই উদ্য়োক্তাদের উচিত সচেতন হওয়া এবং এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর টাকা নষ্ট না করা। বাংলাদেশের এতোগুলো পাবলিক গ্রুপ, ট্রাস্ট, এসোসিয়েশন, চেম্বার, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং বিভিন্ন দপ্তর থাকা সত্ত্বেও কেন শুধুমাত্র “উই” এবং নাসিমা আক্তার নিশাকে পলক এত অনুদান, সুযোগ প্রদান করতেন?
এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায় যে, উদ্যোক্তারা তাদের ইচ্ছায় এইসব প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলেও তাদের সঙ্গে অর্থের ব্যাপারে ধোঁকাবাজি করা হয়। তাদের শিক্ষণীয় হবে আরও সতর্ক থাকা এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া।
ভুক্তভোগীদের দাবি, নিশাদের প্রতারণার উত্থানের পেছনে দায়ীদের এবং নিশাদের যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় এনে বিচার করা হোক। যুগে যুগে অনৈতিক উপায়ে নারীর ক্ষমতায়নের নামে যারা মাফিয়া হয়ে উঠেছে, তারা যেন আর ফিরে না আসতে পারে।