জাল, অবৈধ ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠেকাতে ২০১১ সালে ইলেকট্রনিক চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রবর্তন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। শুরু থেকেই বিআরটিএর হয়ে কাজটি করে দিচ্ছিল দেশী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। তবে আন্তর্জাতিকভাবে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় টাইগার আইটিকে সরিয়ে ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডকে নিযুক্ত করেছে বিআরটিএ। টাইগার আইটির সঙ্গে বিআরটিএর চুক্তি শেষ হবে আগামী ২২ জুন। চুক্তির শেষবেলায় এসে টাইগার আইটি নতুন ভেন্ডরের কাছে সার্ভার হস্তান্তরে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ করছে বিআরটিএ।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার্ভারসহ স্মার্টকার্ড বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আবেদনকারীদের তথ্য নতুন ভেন্ডরকে (মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স) হস্তান্তর করা প্রয়োজন। এগুলো হস্তান্তরের জন্য পুরনো ভেন্ডরকে (টাইগার আইটি) একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা এখনো এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কার্ড সংকটের কারণে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ কার্যক্রম। কেবল জরুরি ভিত্তিতেই সেবাটি প্রদান করা হচ্ছিল। কিন্তু টাইগার আইটির গড়িমসির কারণে জরুরি সেবা কার্যক্রমও হুমকির মুখে পড়েছে। সার্ভার হস্তান্তরে দেরি হওয়ার কারণে অন্তত এক মাসের জন্য জরুরি সেবা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিআরটিএর কর্মকর্তারা।
তবে টাইগার আইটি বলছে, সার্ভার হস্তান্তরের বিষয়ে তারা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। এখনো বেশকিছু কার্ড বিতরণ কার্যক্রম বাকি আছে। চুক্তিবদ্ধ সময়ের মধ্যেই সার্ভারসহ সবকিছু বিআরটিএর কাছে হস্তান্তর করার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ইলেকট্রনিক চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্টকার্ড আমদানি করে গ্রাহকদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে সেগুলো বিতরণের দায়িত্ব ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের।
বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাইগার আইটির সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী এখনো প্রায় ৩০ হাজার স্মার্টকার্ড গ্রাহককে বিতরণ করা বাকি আছে। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছা করেই কার্ড বিতরণের কাজটি অত্যন্ত ধীরগতিতে বাস্তবায়ন করছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে টাইগার আইটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদুল হক শিকদার বলেন, ‘বিআরটিএতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছি। আগামী ২২ জুন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি শেষ হবে। আমরা চেষ্টা করছি এর আগেই সার্ভারসহ সবকিছু হস্তান্তর করার। এজন্য আমরা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি। হস্তান্তরের বিষয়টি আমরা খুব ইতিবাচকভাবে দেখছি।’
এখনো টাইগার আইটি সার্ভার হস্তান্তর না করায় কী সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে বিআরটিএর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সারা দেশে নয় লাখের বেশি আবেদন পেন্ডিং আছে। আবেদনগুলো যে সার্ভারে রয়েছে, তা টাইগার আইটির নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে নতুন ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান কার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হবে জরুরি ভিত্তিতে কার্ড বিতরণ কার্যক্রমটি নিয়ে। সার্ভার হস্তান্তরের পর নতুন ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানটি সেটি বুঝে নিয়ে কার্ড বিতরণ কাজটি শুরু করতেই এক মাসের মতো সময় লাগবে। এ পুরো সময়টি সাধারণ স্মার্টকার্ড তো বটেই, জরুরি ভিত্তিতে স্মার্টকার্ড সরবরাহের কাজও বন্ধ থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের জুলাইয়ে বিআরটিএর সঙ্গে স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় চেন্নাইভিত্তিক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্টকার্ড গ্রাহকদের বিতরণ করবে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির পেছনে বিআরটিএর খরচ হচ্ছে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। চুক্তির ১০ মাস পেরোলেও এখনো কার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে বিআরটিএর বিভিন্ন সার্কেল অফিস থেকে গ্রাহকদের আঙুলের ছাপ নেয়ার কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে সার্ভার বুঝে পেয়ে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু করলেও চলমান স্মার্টকার্ড সংকট সহজে মিটবে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন, ভারতীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা আট হাজার স্মার্টকার্ড। বিপরীতে স্মার্টকার্ডের জন্য যে পরিমাণ আবেদন পেন্ডিং আছে, সেগুলো দিতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে প্রতিদিনই স্মার্টকার্ডের জন্য নতুন নতুন আবেদন জমা পড়ছে। দেশের সার্কেল অফিসগুলোতে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য নতুন আবেদন জমা পড়ছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরের দিকে যেখানে পেন্ডিং আবেদনের সংখ্যা দুই লাখের মতো ছিল, সেখানে পরের প্রায় দেড় বছরে তা সাড়ে নয় লাখে উন্নীত হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের সেবা কার্যক্রমেও করোনা মহামারীর প্রভাব পড়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে স্মার্টকার্ড বিতরণে বিলম্ব হওয়ার পেছনে এটি মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি আমাদের পুরনো ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি শেষ হবে আগামী ২২ জুন। পুরনো ও নতুন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দায়িত্বভার হস্তান্তরের জন্যও কিছুটা সময় লাগছে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু করবে। এরই মধ্যে তারা কার্ড প্রিন্ট করাও শুরু করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে স্মার্টকার্ডের যে একটা সংকট চলছে, এ বিতরণ প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে তা দ্রুতই কেটে যাবে বলে মন্তব্য করেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান।