২০২১ সালে যখন দেশের ই-কমার্স জগতে হঠাৎ আস্থা ধস নামল, তখন ২৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে অর্ডার নেওয়া প্রায় ৫৪৮ কোটি টাকা আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই টাকা ছিল গ্রাহকের, যাঁরা পণ্যের অর্ডার করলেও সেগুলো হাতে পাননি। সৌভাগ্যক্রমে টাকা তখনো পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ওইসব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে যায়নি—আর সেখানেই ব্যাংক বলল, “হোল্ড আপ!”
গত চার বছরে সরকার ধাপে ধাপে ৪২১ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় আবেদন আসার ভিত্তিতে। কিন্তু এখনও ১২৭ কোটি টাকা পড়ে আছে সাতটি পেমেন্ট গেটওয়ের কাছে—যেগুলোর বিপরীতে কোনো নির্ভরযোগ্য লিস্টই আসেনি! ????
কীভাবে আটকানো হয়েছিল টাকা?
২০২১ সালের ৩০ জুন, ই-কমার্সের টাকা লেনদেনে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়—পণ্য হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো টাকা ছাড় নয়। যদি সময়মতো পণ্য না আসে, তাহলে পেমেন্ট গেটওয়ে টাকা ফেরত দেবে গ্রাহককে।
এই নির্দেশনার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠন করে 'কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল', যারা হিসাব-নিকাশ ও রিফান্ড যাচাইয়ের কাজ করে।
কার কার কত টাকা আটকে?
Qcoom: সর্বোচ্চ ৩৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আটকে ছিল। এর মধ্যে ৩৪২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হলেও এখনো ৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ফোস্টার করপোরেশনের কাছে রয়ে গেছে।
E-orange: আটকে ৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, কোনো তালিকা না দেওয়ায় এক টাকাও রিফান্ড হয়নি।
Evaly: আটকে ছিল ২৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ফেরত গেছে ৮ কোটি, বাকি ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা এখনো গেটওয়েতে।
Dalal Plus: আটকে ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ, রিফান্ড হয়নি ১৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
Alesha Mart: আটকে ৪২ কোটি ৭৩ লাখ, ফেরত হয়নি ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
Alif World: আটকে ২ কোটি ৫৩ লাখ, ফেরত হয়নি ২ কোটি ২১ লাখ টাকা।
আরও ১৯টি প্রতিষ্ঠান: আটকে ১৩ কোটি ১৩ লাখ, রিফান্ড হয়নি ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
তালিকা নাই, টাকা নাই!
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান—অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্ডারের লিস্ট দেয়নি। কেউ ডেটাবেস মুছে ফেলেছে, কেউ মালিক নিয়ে পলাতক, কেউ জেলখানায়। আবার কেউ পেয়েও দাবি করছে, “আমি তো পাইনি ভাই!”
তাই সমস্যা আরও গড়িয়েছে। গত অক্টোবরেও নতুন করে অভিযোগ চাওয়া হয়েছিল—তবুও, অনেক রিফান্ড আটকে আছে অনিশ্চয়তার খাঁচায়।
ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগের পাহাড়
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবার অভিযোগ নেওয়া শুরু করে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে:
নতুন অভিযোগ: ৫৬,০০০+
আগে থেকে অনিষ্পন্ন: ২২,০০০
মোট ই-কমার্স সংক্রান্ত অভিযোগ: ৭৮,০০০+
তবে কত টাকা এখনো ফেরত পাওয়ার দাবি আছে—সে হিসাব জানে না কেউ!
ডিজিটাল কমার্সের নামে এ যেন ডিজিটাল ঠকবাজি! অথচ মানুষ বিশ্বাস করেছিল, ক্লিক করলেই পণ্য দরজায়। কিন্তু পণ্যের বদলে এসেছে প্রতারণা আর ঘোর অন্ধকার। টাকা আটকে, গ্রাহক প্যাঁচে, এবং আইন এখনো ধীরে হাঁটে...