অনুবাদের জগতে আমার প্রবেশ অনেকটাই মধুর এক দুর্ঘটনা মাত্র। বছর ছয় আগে শখের বশে ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টার আয়োজিত লিটারেরি ট্রান্সলেশনের এক কর্মশালায় যোগ দিয়ে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি, অনুবাদের কাজটা আমার একটু বেশিই ভালো লাগছে। তার আগ পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনার সুবাদে ছাত্রজীবনে টুকটাক অনুবাদ করেছি। সঙ্গে বাংলাদেশ বেতারের কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু কবিতা অনুবাদের অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবে অনুবাদ পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা কখনো ভাবিনি। কর্মশালা শেষ করার পর ভালো লাগার কাজটা স্বভাবতই আরও বেশি বেশি করতে শুরু করলাম।
পেশাগত কাজ শুরু করি একটি স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থার কিছু বই অনুবাদের কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। প্রতিদিন অফিসের একঘেয়ে কাজ শেষে বাসায় এসে ল্যাপটপ অন করতেই এক ধরনের মুক্তির আনন্দ অনুভব করতাম। বলতে দ্বিধা নেই, অনুবাদ থেকে আসা টাকার অঙ্কটাও কম ছিল না। সংসারের খরচ চালাতে বেশ সুবিধা হতে লাগল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের চাপ বেড়ে যেতে লাগল। পরিচিতির পরিসর কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় তত দিনে সম্মানীর অঙ্কটাও বেড়ে গেছে। একপর্যায়ে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অনুবাদের কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করলাম।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে কাজ করেছি দেশের প্রখ্যাত সব এনজিও, করপোরেট সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে। অনুবাদের পাশাপাশি সম্পাদনা, ট্রান্সক্রাইব, বানান দেখা, কনটেন্ট লেখা, আরও নানা ধরনের কাজের অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবে অনুবাদের কাজটা যেভাবে আনন্দ নিয়ে করা যায়, তেমনটা আর কোনো কাজের ক্ষেত্রে অনুভব করিনি।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ‘অনুবাদক’ পেশাটি বেছে নেওয়া একদিকে চ্যালেঞ্জিং হলেও পূর্ণকালীন পেশাদার অনুবাদকের অভাবের কারণে এখানে কাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। অনেকেই মনে করতে পারি যে দু’টো ভাষায় মোটামুটি দখল থাকলেই বুঝি অনুবাদক হিসেবে কাজ করা যায়। বাস্তবে, দুই ভাষার ওপর দক্ষতার পাশাপাশি কিছু বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। প্রথমেই বলব ‘সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা যেই ভাষা থেকে অনুবাদ করতে ইচ্ছুক, সেই ভাষাটিকে খুব ভালোভাবে রপ্ত করে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সেই ভাষার ওপর সহজলভ্য কোনো কোর্স করে ফেলতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন ভাষার ওপর নানা দৈর্ঘ্যের কোর্স খুঁজে পাবেন। প্রয়োজনীয় কোর্সটি বেছে নিন। প্রয়োজনে অনুবাদ শেখার জন্য বিশেষায়িত কোর্সগুলোতেও ভর্তি হতে পারেন। ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টার সাহিত্য অনুবাদের জন্য নানা ধরনের কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। এ ছাড়া, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়মিতই অনুবাদ সংক্রান্ত কর্মশালা আয়োজন করে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত অনুবাদকদের সান্নিধ্যে অনুবাদের নানা ধরনের কায়দা-কৌশল এখানে হাতে কলমে শিখতে পারবেন।
আপনি যদি কোনো বিশেষ শাখার লেখা অনুবাদ করতে আগ্রহী হন, তাহলে সেই শাখায় ব্যবহৃত শব্দ ও পরিভাষা সম্পর্কে ব্যাপক পরিসরে পড়াশোনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত পরিভাষা শব্দকোষগুলো আপনাকে সাহায্য করবে। ভাষার দক্ষতার সঙ্গে কম্পিউটারে কাজ করার দক্ষতা, টাইপিং স্পিড, অনুবাদের টুল ব্যবহারের দক্ষতা জরুরি। এই দক্ষতাগুলো আপনার কাজকে অনেক সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলবে।
প্রস্তুতি শেষের পর কাজ পেতে এক অন্য রকম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথম দিকে আপনার ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কের মধ্য থেকেই কাজ খুঁজে নিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করতে হতে পারে। মনোযোগের সঙ্গে নিজের সেরা প্রচেষ্টাটুকু দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করুন। দেখবেন, পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তৃত পরিসরে কাজের সুযোগ চলে আসবে।
ফ্রিল্যান্সিং পেশাগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই খুব ভালোভাবে জানি, এখানে কাজের মান ধরে রাখতে না পারলে খুব বেশি দিন কাজ করা সম্ভব হয় না। কাজেই প্রতিটি ছোট-বড় কাজকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করুন। কোন কাজের জন্য অনুবাদের কোন ধরনটি অনুসরণ করবেন, তা বুঝে নিন। অনেক প্রতিষ্ঠান আজকাল অভ্যন্তরীণ কাজের সুবিধার্থে পূর্ণ মেয়াদে অনুবাদক নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফ্রিল্যান্সিং করতে না চাইলে সেসব প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন। সবশেষে বলব, কাজের প্রতি আপনার নিষ্ঠা থাকলে সাফল্য অবধারিত।
লেখক: পেশাদার অনুবাদক