ঢাকা | বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ |
২২ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনঃ ফেসবুক বাংলা পড়তে জানে না!

সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনঃ ফেসবুক বাংলা পড়তে জানে না!
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনঃ ফেসবুক বাংলা পড়তে জানে না!

কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড় থেকে সেদিন ফেসবুকে মিনিট তিনেক দৈর্ঘ্যের লাইভ করেছিলেন ইবনে বতুতা রোহান জামিল ফাহিম। লাইভের সারকথা ছিল, পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়া গেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সেই কোরআন শরিফ সরাতে চাইছেন না। ধর্মের সঙ্গে আবেগ জড়িত। তাই যার কাছে যা আছে, তা নিয়ে সবাই নেমে পড়বেন। পুলিশ ঘিরে রেখেছে তাঁদের। তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ।

গত ১৩ অক্টোবর নানুয়ার দিঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রয়েছে এ খবর পেয়েই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ঘটনাস্থলে যান এবং পবিত্র গ্রন্থ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ সরাতে চাইছিলেন না—এই মতের সমর্থনে কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর মধ্যেই ইবনে বতুতা রোহান জামিল ফাহিমের ভিডিওটি দেখা হয়ে যায় ১০ লাখ বার। সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকে উসকে দেওয়া ভিডিওগুলোর মধ্যে ইবনে বতুতারটি ছিল অন্যতম।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (বিটিআরসি) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানাচ্ছে, কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনী কিংবা রংপুরের পীরগঞ্জে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব সামলাতে হিমশিম খেয়েছে তারা। শুধু ১৩ অক্টোবর এবং পরের কয়েক দিনে প্রায় ৩০০ আইডি ব্লক করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গুজবের মাধ্যমে সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, শিশু পর্নোগ্রাফি, পাচারের মতো অপরাধে অনুঘটকের কাজ করছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো।

বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারির জন্য বিটিআরসির নিজস্ব সেল রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নজরদারি করে। বিটিআরসির সঙ্গে তাদের সমন্বয়ও আছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো কোনো একটি ভিডিও বা পোস্ট সব জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার পর সরকারি সংস্থাগুলো জানতে পারছে। এরপর তারা যোগাযোগ করছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ অন্য মাধ্যমগুলোর সঙ্গে। এই মাধ্যমগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু করছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেটা (ফেসবুক) মুখপাত্র ই-মেইল বার্তায় জানায়, জরুরি পরিস্থিতি যেমন আত্মহত্যা বা অন্যান্য ক্ষতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মেটার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে।

ফেসবুক আরও জানিয়েছে, ‘আমাদের একটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়া আছে। যখনই সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে আমরা কোনো অনুরোধ পাই, সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী কাজ করে থাকি। অন্য যেকোনো দেশের অনুরোধ যেভাবে নিষ্পত্তি করা হয়, একইভাবে বাংলাদেশেরটিও করা হয়ে থাকে।’

সিএনএন ‘ফেসবুক হ্যাজ ল্যাঙ্গুয়েজ ব্লাইন্ড স্পটস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড দ্যাট অ্যালাউ হেট স্পিচ টু ফ্লারিশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ নথিপত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, ফেসবুক বাংলা পড়তে জানে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, যতটুকু তথ্য ফেসবুকসহ অন্য মাধ্যমগুলো দিচ্ছে ততটুকু যথেষ্ট নয়। আবার এ অভিযোগও আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যত অনুরোধ পাঠায়, তার একটা বড় অংশ সরকারের সমালোচনাকারীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে।

গুজব ও ধর্মীয় সহিংসতা ছড়াতে ব্যবহার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আইটি ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের শিক্ষক লিওন ডারশিনস্কি গুজবের চারটি প্রকার ভেদের কথা বলেছেন। এগুলো হলো, স্পেকুলেশন বা ফটকাবাজি, কন্ট্রাভার্সি যা বিতর্ক ও সংঘর্ষ তৈরি করতে পারে, মিস ইনফরমেশন বা না জেনে কোনো তথ্য, মিথ্যা ডাটা প্রকাশ করা এবং ডিজইনফরমেশন বা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে জেনেশুনে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে বাংলাদেশে সব ধরনের গুজব ছড়াতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার হচ্ছে।

সিআইডি ও সিটিটিসি সূত্র বলছে, যেকোনো ধরনের গুজবের মধ্যে ধর্মীয় ইস্যুতে গুজব দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে।

কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপ থেকে ফয়েজ উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি প্রথম ফেসবুক লাইভে আসেন। ওই লাইভ থেকেই গুজবের ডালপালা নানান দিকে ছড়াতে শুরু করে। মণ্ডপের দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে উত্তেজিত মানুষ এগোচ্ছেন, এমন একটি জটলার ভিডিওতে একজনকে একাধিকবার বলতে শোনা যায়, ‘লাইভ করে দাও,’ ‘লাইভ করে দাও’।

৮২ শতাংশ উগ্রবাদী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। সিটিটিসির সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধবিষয়ক একটি নথিতে দেখা যায়, ২০১৬ সালের তুলনায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম ২০১৯ সাল নাগাদ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার হার এই সময়ে বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উদ্বুদ্ধ করার একটি বড় ক্ষেত্র। এখানে সক্রিয় আছে ৮২ শতাংশ উগ্রবাদী। ২০১৬ সালে উগ্রবাদীদের মঞ্চ দাওয়ালিল্লাহ ফোরামে সদস্য সংখ্যা ছিল সাড়ে ৫০০, তিন বছর পর এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজারে।

সংখ্যালঘু,নির্যাতন,ফেসবুক
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend