উপজেলা পর্যায়ে ৫জি নেটওয়ার্কের প্রস্তুতিতে নেয়া প্রকল্পে সম্ভাব্য ও প্রাক্কলিত দর থেকে ১৩৭ কোটি টাকার সাশ্রয় করতে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ব টেলিকম অপারেটর বিটিসিএল। তবে সর্বোচ্চ আদালতে বিটিসিএল-কে বিবাদী করে এ নিয়ে করা আপিলে পুরো প্রকল্পটিই বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সূত্রমতে, কারিগরি মূল্যায়ন শেষে বুধবার (৮ নভেম্বর) বিসিএল এর বাণিজ্যিক দরপত্র উন্মুক্ত করার পর সবনিম্ন দরদাতার সপক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর মুহূর্তেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের বেঞ্চে আইনজীবি তপন কুমার বিশ্বাসের মাধ্যমে এই রিট করা হয়। বেঞ্চে জমা পড়া ১৩৮তম এই রিট আবেদনটি করেন ইন্টারনেট গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠনের প্রতিনিধি সেলিম আশরাফ চৌধুরি গং। বিষয়টি নিয়ে শুনানিতে আগামী ২০ নভেম্বর তারিখ দিয়েছেন বিচারক। এর আগে এই একই ব্যক্তির উচ্চ আদালতে বিটিসিএল ও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আসাদুজ্জামান চৌধুরীর বিপক্ষে দেয়া দরপত্র কার্যক্রম পরিচালনায় দেয়া স্থগিতাদেশ আবেদনটি গত ৬ নভেম্বর ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখার আদেশ দেন এই সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ।
বুয়েটের কারিগরি মূল্যায়ণ এবং এ নিয়ে সিপিটিইউ এর নির্দেশনা অনুযায়ী, ৮ নভেম্বর উন্মুক্ত হওয়া দরপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দরপত্রে রেসপন্সিভ তিনটি কোম্পানি মধ্যে জেডটিই, হুয়াওয়ে এবং স্মার্ট-নকিয়া যথাক্রমে ৪১৫ কোটি, ৩২৬ কোটি ও ৫৭৯ কোটি টাকা টাকায় দরপত্র দাখিল করে। সেই হিসেবে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে হুয়াওয়ে থেকে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারীর ব্যবধান ৯০ কোটি টাকা।
কিন্তু তারপরও এ নিয়ে আদালতে রিট করা কতটুকু জনস্বার্থে না কি প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে ৫জি যাত্রায় পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বনিম্ন দরে চাহিদা অনুযায়ী সর্বোত্তম প্রযুক্তির ব্যবহার ঠেকাতে রিট মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এর পেছেনে রাষ্ট্রকে পিছিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র হাতে পারে।
কেননা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)’র সভার সিদ্ধান্ত ৪.৪ অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (Feasibility Study) সম্পাদন করা হয়। সরকারের ২৮.৭৫ লক্ষ টাকা খরচের এই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন (Feasibility Study Report) ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে জমা দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে “৫জি’র উপযোগীকরণে বিটিসিএল এর অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন” প্রকল্পের ডিপিপি বুয়েট প্রণীত সমীক্ষার আলোকে প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে সংস্থা প্রধান হিসেবে বিটিসিএল এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ রফিকুল মতিন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন সচিব মোঃ খলিলুর রহমানের স্বাক্ষরের পর এ বিভাগের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের অনুমোদনে পরিকলপনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়।
বিটিসিএল) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও টেলিযোগাযোগ অধিদফতরের মহাব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। দরপত্র বাতিলের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ না হয়েও এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে দরপত্র বাতিল করায় এবং অসৎ উদ্দেশ্যে কাজ করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
গত ৭ নভেম্বর (মঙ্গলবার) রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আসাদুজ্জামান চৌধুরী ফাইভ-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএল’র অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আহ্বান করা ‘টেন্ডার অব সাপ্লাই ইন্সটলেশন, টেস্টিং অ্যান্ড কমিশনিং অব এএসওএন বেজড ডিডাব্লিউডিএম ট্রান্সমিশন সিস্টেম অন টার্ন কি বেসিস’ শীর্ষক দরপত্রে সব আবেদনকারীকে বাতিলপূর্বক পিপিআর-২০০৮-এ বর্ণিত সময়সীমা ১৫ দিন না মেনে ৫৫ দিন পরে পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। বিষয়টি নিয়ে ত্রুটি বিচ্যুতি সংশোধনের পর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ অনুসরণ করে নিষ্পত্তি করার পরামর্শ দেওয়া হলেও সেটি অনুসরণ করেননি তিনি।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এমন সিদ্ধান্ত বিধিবহির্ভূত এবং অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এমন আচরণ সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর খ, অ, আ, ই, উ মোতাবেক ‘অসদাচরণ’ যা উক্ত বিধিমালার বিধি-৩ (খ) ও (ঘ) অনুযায়ী দণ্ডযোগ্য অপরাধ।
এই কারণে আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ১২(১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
পরিকলপনা কমিশনের সুপারিশে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ডিপিপি উপস্থাপিত হয়। বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ওই সভায় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মহাসড়কে উঠবে বলে মত দেন। এরপর বর্ণিত প্যাকেজের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের নিমিত্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ এপ্রিল কারিগরি বিনির্দেশ (Technical Specification) প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।
যেহেতু টেন্ডারটি ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত, তাই বিটিসিএল এর ট্রান্সমিশন বিষয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠন করা হয় এবং এ কমিটিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্ত ছিল। উক্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি দীর্ঘ প্রায় ৫ (পাঁচ) মাস ধরে মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এবং ট্রান্সমিশন খাতে কাজ করেছে এমন সম্ভাব্য দরদাতা এবং বিভিন্ন অংশীজনের (Stakeholder) সঙ্গে বিটিসিএল এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গত বছরের ২ জুন মতবিনিময় সভা করেন এবং তাদের মতামত, পরামর্শ গ্রহণপূর্বক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং ডিপিপির আলোকে দরপত্রের কারিগরী বিনির্দেশ প্রস্তুত করেন। এই কারিগরী বিনির্দেশটি ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সংস্থা প্রধান হিসেবে বিটিসিএল এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ রফিকুল মতিন অনুমোদন করেন। কারিগরি বিনির্দেশের আলোকে ১৩ সেপ্টেম্বর দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় (Official cost estimate) অনুমোদন করা হয়।
দরপত্র বিনির্দেশ প্রণয়ন কমিটি প্রণীত নির্দেশটি HOPE অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিটিসিএল অনুমোদনের পর এ প্যাকেজের ক্রয় কাজের বিপরীতে ১৪ সেপ্টেম্বর “Supply, Installation, Testing and Commissioning of ASON Based DWDM Transmission System on Turn-Key Basis” শিরোনামে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রটিতে সিপিটিইউ এর স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাট (PG-5A) ব্যবহার করা হয় এবং এটা এক ধাপ দুই খাম পদ্ধতিতে (One Stage Two Envelope) পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করা হয়। দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি ১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফক এবং দ্য ডেইলি অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। এছাড়া বিটিসিএল এর ওয়েবসাইট এবং সিপিটিইউ এর ওয়েবসাইটেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ।
তারপরে বিগত ২৮ সেপ্টেম্বর বিটিসিএল ডিএমডি (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সঞ্জীব কুমার ঘটকের এর সভাপতিত্বে প্রাক-দরপত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নকিয়ায়, জেডটিই, ফাইবার অ্যাট হোম, তেজাস ও জিনিও -সহ অন্যান্য সম্ভাব্য ভেন্ডর উপস্থিত ছিলেন । সেখানে এদের কেউই স্পেসিফিকেশন নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেননি। এছাড়াও গত বছরের ৩০ অক্টোবর Bidder ও Stakholder দের সঙ্গে তৎকালীন টেলিকম সচিব খলিলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত BoD, BTCL এর সভায়ও কোনো ভেন্ডর বিনির্দেশের বিষয়ে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। পিপিআর-২০০৮ এর বিধি (৭) এর আওতায় গঠিত ৩(তিন) সদস্যের দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির মাধ্যমে গত ২০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্রটি উন্মুক্ত করা হয়। দরপত্র পদ্ধতি এক ধাপ দুই খাম পদ্ধতি হওয়ায় দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি শুধুমাত্র কারিগরি প্রস্তাব উন্মুক্ত করেন। সেখানে দেখাযায়, জেডটিই, হুয়াওয়ে ও স্মার্ট-নকিয়া দরপত্র দাখিল করেছে।