বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) শীঘ্রই মোবাইল অপারেটর রবি,জিপি,বাংলালিংক ডিডব্লিউডিএম (ডেন্স ওয়েভলেন্থ ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং) যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই অনুমতি পেলে মোবাইল অপারেটররা তাদের নিজস্ব ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদানেও সক্ষম হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে স্থানীয় ট্রান্সমিশন ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। এতে কয়েক হাজার বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও কর্মী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। পাশাপাশি, টেলিযোগাযোগ খাত পুরোপুরি বিদেশী মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে, যা দেশীয় বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তাদের জন্য বাধা সৃষ্টি করবে। প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট সেবার খরচ কমার সম্ভাবনা থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে বিদেশী কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা লাভ করবে, ফলে ইন্টারনেটের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তদুপরি, ডাটা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে, কারণ দেশের সমস্ত তথ্য প্রবাহ বিদেশী কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, তিনটি মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান একটি বিদেশী মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটরের দখলে চলে গিয়েছিল। সে সময় ট্রান্সমিশন ও ব্যান্ডউইথ সরবরাহের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের ফলে অন্য দুই মোবাইল অপারেটরকে প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হতো। একইসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ পরিবহনের খরচও অত্যন্ত বেশি ছিল। ফলস্বরূপ, ফাইবার অপটিক সেবা সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি হয় এবং ডিজিটাল বৈষম্য বাড়ে।
এই পরিস্থিতি নিরসনে ২০০৮ সালে টেলিযোগাযোগ খাতে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এর মাধ্যমে ট্রান্সমিশন সেবায় কমন নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য এনটিটিএন, আন্তঃসংযোগের জন্য আইসিএক্স, পাইকারি ইন্টারনেট সরবরাহের জন্য আইআইজি এবং আন্তর্জাতিক ভয়েস কল টার্মিনেশনের জন্য আইজিডব্লিউ অপারেটরের লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এতে ট্রান্সমিশন খরচ এবং ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে, এবং টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য হ্রাস পায়।
বর্তমানে, মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিলে দেশীয় ট্রান্সমিশন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা তাদের প্রধান গ্রাহক হারাবে এবং তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। পাশাপাশি, ট্রান্সমিশন ও ব্রডব্যান্ড সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোতে কর্মরত প্রায় দশ হাজার প্রকৌশলী ও কর্মী বেকার হয়ে পড়তে পারেন। ইতিমধ্যে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো থেকে বহু বাংলাদেশি কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
তদন্তে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে দুটি মোবাইল অপারেটর গোপনে ১৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যা ট্রান্সমিশন ও ব্রডব্যান্ড ব্যবসার জন্য অবৈধ প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়। তারা এই বিনিয়োগের অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে চায়। গত এক দশকে বিদেশী মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটররা সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ করেনি; বরং দেশীয় ব্যাংক ঋণ এবং বাংলাদেশে অর্জিত আয় ব্যবহার করে তারা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে। স্থানীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছে, কিন্তু বিটিআরসি এখন পর্যন্ত তা কার্যকর করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম ব্যবহারের অনুমতির আগে বিটিআরসির একটি পূর্ণাঙ্গ টেকনিক্যাল অনুসন্ধান করা উচিত। এতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর অবৈধ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক গঠন, বিনিয়োগের গড়মিল এবং কলড্রপ ও ধীরগতির ইন্টারনেট সেবার প্রকৃত কারণ উন্মোচিত হবে। পাশাপাশি, বর্তমান ভ্যালুচেনে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা ও অবদান নির্ধারণ করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, গত এক দশকে এনটিটিএন গাইডলাইন সংশোধনের জন্য একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও মোবাইল অপারেটরদের অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী সেবা নিশ্চিত করতে কীভাবে নীতিমালা সংশোধন করা যায়, সে বিষয়ে একটি সুপারিশমালা রয়েছে। তবে বিটিআরসি তা উপেক্ষা করে অবকাঠামো ভাগাভাগি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়, যা সমালোচনার মুখে ব্যর্থ হয়। বর্তমানে, নতুন কৌশলে মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে ডাটা নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কসহ টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ডিডব্লিউডিএম ব্যবহারের অনুমতি বিদেশী মোবাইল অপারেটরদের দেওয়া হলে, তা ভবিষ্যতে দেশের ডাটা সুরক্ষাকে গুরুতর ঝুঁকিতে ফেলবে। তাই, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত ও যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।