খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতের কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে ইলেকট্রনিক্স ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর চুক্তি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই চুক্তিতে প্রথম ধাপে তিনটি জোনে ৬০ হাজার ইএফডি যন্ত্র বসানোর কথা থাকলেও কোম্পানিটি প্রায় দুই বছরে ১৪ হাজার যন্ত্র স্থাপনের কথা জানিয়েছে এনবিআরকে। বাস্তবে ১১ হাজার ৩১৩টি ইএফডি স্থাপনের প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। অর্থাৎ কম মেশিন সরবরাহ করে বেশি দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে নির্ধারিত আকৃতির (কনফিগারেশন) বাইরে ইএফডি স্থাপন করারও প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। সংস্থাটির তদন্ত প্রতিবেদনে অনিয়মের এসব চিত্র উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের নভেম্বরে এনবিআরের সঙ্গে ইএফডি বসাতে চুক্তিবদ্ধ হয় জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বছরে তিনটি জোনে ভাগ করে ২০ হাজার করে মোট ৬০ হাজার ইএফডি মেশিন বসানোর কথা। কিন্তু জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড ১১ হাজার ৩১৩টি ইএফডি স্থাপন করে ১৪ হাজার ২৪৮টি মেশিন সরবরাহের তথ্য দিয়েছে এনবিআরকে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৯৫টি এসডিসি (সেলস ডাটা কন্ট্রোলার) বসানোর দাবি করলেও তদন্ত কমিটি ৯৭টি এসডিসি যন্ত্র বসানোর প্রমাণ পেয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে বসানো মেশিনেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছে জেনেক্স ইনফোসিস। প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেমে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ইএফডি বসানোর হিসাবে ব্যাপক গরমিল পেয়েছে এনবিআরের গঠিত তদন্ত কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেনেক্স ইনফোসিসের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান আবু জাহিদ পরাগ বলেন, ইএফডি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে এনবিআর থেকে এখনো আমাদের জানানো হয়নি। এনবিআর এই প্রকল্পে সফল অগ্রগতির জন্য বেশকিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করছি।
ইএফডি-সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইএফডি ব্যবহার বা সিস্টেম তদারকির জন্য এনবিআরের কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের শর্ত থাকলেও কোম্পানি তা করেনি। করদাতাদের প্রশিক্ষণের শর্ত থাকলেও জেনেক্স ইনফোসিস তা মানেনি। কোন বিদেশি কোম্পানি থেকে ইএফডি নিয়ে আসা হয়েছে, সেই কোম্পানি পরিদর্শনের কথা থাকলেও তা করেনি জেনেক্স। কোম্পানির পক্ষ থেকে বিকেল ৫টার পর থেকে তদারকির কথা থাকলেও ওই সময়ের পর জেনেক্সের কোনো কর্মীকে পাওয়া যায়নি। ইএফডি ব্যবহার করে কেউ অনিয়ম করছে কি না, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কমিশনারকে অবহিত করার কথা থাকলেও জেনেক্স কোনো কমিশনারকে অবহিত করেনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন করেছে। এই হারে ইএফডি বসালে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হবে বলেও মনে করে এনবিআরের তদন্ত কমিটি। ইএফডি যন্ত্রের সঙ্গে সার্ভার সংযোগ নিয়মিত রাখার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক সমস্যা রয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। যার কারণে যন্ত্র থেকে সিস্টেমে তথ্য শেয়ার হয় না। একই সঙ্গে বাধাগ্রস্ত হয় রিয়েল টাইমে (সঠিক সময়) কাজ করা। যেভাবে জেনেক্স ইনফোসিস কাজ করছে—এমনটা চললে এনবিআরের বর্ধিত সময়ে (চলতি বছরের জুন) ৬০ হাজার ইএফডি বসানোর সম্ভাবনা খুবই কম বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি।
এদিকে এনবিআরের গঠিত আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটিও ইএফডি সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। এই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
জানতে চাইলে ইএফডি-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইএফডি সরবরাহ থেকে শুরু করে মনিটরিং পর্যায়ে জেনেক্সের নানা ধরনের গাফিলতি রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ইএফডি বসানো নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। আর চুক্তি অনুযায়ী, প্রশিক্ষণের কথা থাকলেও জেনেক্স তা মানেনি। কনফিগারেশন অনুযায়ী ইএফডি মেশিন সরবরাহ করেনি তারা।
এনবিআর সূত্র জানায়, এত জাল-জালিয়াতির পরও কোম্পানিটি সারা দেশে ইএফডি সরবরাহের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে। এতে ইএফডি আমদানির জন্য কর মওকুফের আবেদনও করেছে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির এই চিঠিটি অর্থ উপদেষ্টা হয়ে এনবিআরের কাছে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহ জালাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে বলা হয়েছে, এনবিআরের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৫ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে ৩ লাখ ইএফডি বসাবে। এজন্য কোম্পানিটি ইএফডি আমদানিতে কর মওকুফ চেয়েছে। একই সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া কমিশনের হার বাড়ানোর জন্যও বলেছে জেনেক্স ইনফোসিস।