ঢাকা | রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ |
৩৩ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

ইকবাল এর ব্যক্তিগত এটিএম প্রিমিয়ার ,ভাড়া বাবদই খেয়েছেন ২২০ কোটি টাকা

ইকবাল এর ব্যক্তিগত এটিএম প্রিমিয়ার ,ভাড়া বাবদই খেয়েছেন ২২০ কোটি টাকা
ইকবাল এর ব্যক্তিগত এটিএম প্রিমিয়ার ,ভাড়া বাবদই খেয়েছেন ২২০ কোটি টাকা

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যযখন দেশের ব্যাংকিং খাতে ভুয়া ঋণের ছড়াছড়ি নিয়ে চলছে হইচই, তখনই একটু অন্য পথে, একটু গোপন গলি বেয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর এই গোটা কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি, তিনি আর কেউ ননব্যাংকটির দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবাল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে, কীভাবে প্রিমিয়ার ব্যাংককে ইকবাল পরিবার ব্যবহার করেছে যেন সেটা ছিল একান্ত নিজস্ব এটিএম! যখন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উর্ধ্বগতি ছুঁয়েছে আকাশ, তখনই দেখা যাচ্ছে ব্যাংকটির অর্থ গেছে পরিবারের ব্যবসা আর সম্পত্তির পেছনে।

ইকবাল সেন্টারভাড়ার নামে বিপুল অর্থ অপচয়

গোটা দুর্নীতির মাঝখানে রয়েছে বনানীতে অবস্থিতইকবাল সেন্টার’—এইচবিএম ইকবালের মালিকানাধীন ভবন, যা প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতিবছর ব্যাংকটি বাজার মূল্যের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি ভাড়া দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যেখানে এসএমসি টাওয়ারে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ১৩০ টাকা, সেখানে প্রিমিয়ার ব্যাংক ৪৪০ থেকে ৪৬২ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১ সালের নতুন চুক্তি অনুযায়ী, বছরে অতিরিক্ত ৬১ কোটি টাকার বেশি ভাড়া গচ্চা গেছে। এমনকি অসম্পূর্ণ অব্যবহারযোগ্য দুটি ফ্লোরের (২০ ২১ তলা) জন্য ৪২ মাসে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকা, যদিও সরেজমিনে দেখা গেছে ফ্লোর দুটি কেবল ছাদে সীমাবদ্ধ, দেয়াল বা কোনো নির্মাণকাজই হয়নি।

এতসব খরচ ছাড়াও ইকবালের প্রতিষ্ঠানে অগ্রিম ভাড়া বাবদ আরও ২২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়, যা পূর্বের অগ্রিম সমন্বয়ের (১৫৯.৩২ কোটি টাকা) তুলনায় অনেক বেশি। থেকে চুক্তি লঙ্ঘনের সম্ভাবনা স্পষ্ট।

পরিবারের আরও সম্পত্তিতে ভাড়া অস্বচ্ছ লেনদেন

ভাইস চেয়ারম্যান মঈন ইকবালের মালিকানাধীন তেজগাঁও শিল্প এলাকার একটি টিনশেড গুদাম ভাড়া নেওয়া হয়েছে বছরে .৭৫ কোটি টাকায়যেখানে গুদামের এক-চতুর্থাংশও ব্যবহৃত হচ্ছে না। অথচ সহজেই নিজস্ব জমিতে স্থাপনা তৈরি করে এই ব্যয় কমানো যেত।

এছাড়া গুলশানে এইচবিএম ইকবালের স্ত্রীর মালিকানাধীনপ্রিমিয়ার স্কয়ারথেকে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান পিবিএসএলের জন্য ১০,৪০০ বর্গফুট ভাড়া নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে কেবল ৫১০ বর্গফুট ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে সাবেক চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত চেম্বার, হোটেলের কনফারেন্স রুম স্টোররুম হিসেবে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক পিবিএসএলকে ঋণ দিয়েছে ২৩০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ১০৬ কোটি টাকার কোনো তথ্য ব্যাংকের ঋণ বিবরণীতে নেই এবং সুদ আরোপ করা হয়েছে মাত্র শতাংশ হারে, যা অস্বাভাবিকভাবে কম।

ফাউন্ডেশনের তহবিলেও গরমিল

প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের অর্থ বরাদ্দেও রয়েছে অপব্যবহারের ছাপ। নিয়ম অনুযায়ী, সর্বোচ্চ কোটি বা বার্ষিক মুনাফার শতাংশ অনুদান দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ২০২৩ সালে ৩০ কোটি এবং ২০২৪ সালে আরও কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এই টাকা খরচ করা হয় ইকবাল পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, জেড রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির নামে।

তদারকির ঘাটতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কোনো ব্যাংক পরিচালকের মালিকানাধীন ভবনে অফিস নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তুপ্রভাবশালীইকবাল পরিবারের কারণে একসময় অনেক কিছুই বাধ্য হয়ে অনুমোদন দিতে হয়েছে।

বিশেষ পরিদর্শনে অনিয়ম ধরা পড়ার পর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

খারাপ ঋণ বাড়ছেই, চেয়ারম্যান বদল

২০২৫ সালের মার্চে প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ,৮১৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। অথচ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল মাত্র ,৬১১ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ,০১৬ কোটি টাকা।

স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি এইচবিএম ইকবাল তার ছেলে মঈন ইকবাল পদত্যাগ করেন। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তার আরেক ছেলে ইমরান ইকবাল।

মামলা, নিষেধাজ্ঞা, আর সাড়া না পাওয়া

দুদক এইচবিএম ইকবালের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত করছে। এরইমধ্যে তার স্ত্রীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, তারা বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। গত নভেম্বরে তাদের এবং সন্তানদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

এই বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২৩ জুলাই প্রতিবেদক দুই ঘণ্টা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অপেক্ষা করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

যেন এক ব্যাংক নয়, একেবারে পারিবারিক সম্পদখেলাঘর! আর খেলাটা এতটাই নিখুঁতভাবে সাজানো যে, খেলার মাঠেই গরিব আমানতকারীদের ঘাম ঝরে যাচ্ছেকেউ জানে না, কবে খেলাটা থামবে।

ইকবাল এর ব্যক্তিগত এটিএম প্রিমিয়ার,ভাড়া বাবদই খেয়েছেন ২২০ কোটি টাকা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend