ঢাকা | শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ |
২৫ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে মোট ব্যয়ের কমপক্ষে ২৩ থেকে ৪০ শতাংশের দুর্নীতি: টিআইবি

ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে মোট ব্যয়ের কমপক্ষে ২৩ থেকে ৪০ শতাংশের দুর্নীতি: টিআইবি
ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে মোট ব্যয়ের কমপক্ষে ২৩ থেকে ৪০ শতাংশের দুর্নীতি: টিআইবি

রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিকভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক ও সেতুসংশ্লিষ্ট নির্মাণ কাজের কার্যাদেশের অর্থমূল্যের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ দুর্নীতি হয়ে থাকে, টাকার অঙ্কে যা ২৯ হাজার ২৩০ থেকে ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। “সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পে বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১৬ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সড়ক ও মহাসড়ক খাতে রাজনীতিবিদ, সংশ্লিষ্ট আমলা ও ঠিকাদারের ত্রিপাক্ষিক আঁতাতের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমের নীতিনির্ধারণ, সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে করায়ত্ত করা হয়েছে। ফলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। সুশাসনের সকল মানদণ্ডে ব্যাপক ঘাটতি চিহ্নিত হয়েছে। ত্রিপাক্ষিক যোগসাজশের মাধ্যমে সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ ও বিলপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষ, রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি, দরপত্র লাইসেন্স ভাড়া, কার্যাদেশ বিক্রয়, সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক ও সেতুসংশ্লিষ্ট নির্মাণ কাজের কার্যাদেশের অর্থমূল্যের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ দুর্নীতি হয়ে থাকে।

গবেষণায় দেখা যায়, নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ প্রাপ্তি ও ঠিকাদারের বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষ ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, নির্মাণ কাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়েছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ, দরপত্র লাইসেন্স ভাড়া, কার্যাদেশ বিক্রয়, সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে ২ থেকে ৬ শতাংশ।

গবেষণায় আরো উঠে এসেছে, ঠিকাদারদের মাঝে সমঝোতা ও যোগসাজশের মাধ্যমে গত দশ বছরে শীর্ষ ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সওজ অধিদপ্তরের ক্রয়ব্যবস্থা করায়ত্ত করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১৩-১৪ অর্থ বছর থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত সময়ে শুধুমাত্র ইজিপি প্রক্রিয়ায় দরপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থবছরে শীর্ষ পাঁচে থাকা ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একক ও যৌথভাবে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকার সড়ক/সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট কার্যাদেশ পেয়েছে। যা ইজিপি প্রক্রিয়ায় প্রদত্ত নির্মাণসংশ্লিষ্ট কার্যাদেশ মূল্যের প্রায় ৭২ শতাংশ।

রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আমলাতন্ত্র ও ঠিকাদারদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের ফলে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ স্বার্থান্বেষী মহলের সম্পদ বিকাশের উপায়ে পরিণত হয়েছে— উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখলাম, সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ দুর্নীতি হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প উন্নয়ন ব্যয় দক্ষিণ এশিয়া ও আমাদের পার্শ্ববর্তীদেশ থেকে ২ থেকে ৯ গুণ বেশি। আমাদের এই ত্রিপক্ষীয় আঁতাত ভাঙতে হবে, এই আঁতাতে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন আইনের লঙ্ঘন নিয়ন্ত্রিত হয়, বিশেষ করে ক্রয় নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন হয়। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও আইনি ফাঁকফোকরকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়ার যে প্রবণতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা দূর না পারলে যতই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হোক না কেনো, তা বাস্তবায়িত হবে না। এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সকলকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে আহ্বান জানাই।’

অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রতিরোধক আইন প্রণয়ন ও কার্যকর প্রয়োগের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘রাজনীতি-আমলাতন্ত্র-ব্যবসানির্ভর ত্রিপক্ষীয় আঁতাত ভাঙতে না পারলে আবার দুর্নীতি সুরক্ষাকারী কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসতে হবে। তবে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ও দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পরিবর্তন হলে অনিয়ম-দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব হবে। উন্নয়ন হয়েছে তা আমরা অস্বীকার করছি না, তবে তা স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তদুপরি যতটুকু অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তা আরো অনেক কম ব্যয়ে হতে পারতো। বেশি অর্থ ব্যয়ে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হওয়ায় জনগণের ওপর বেশি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতির কারণে অবকাঠামোর গুণগত মান ভালো হয়নি। যার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় আরো অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা একটি দুষ্ট চক্র। একে ভাঙ্গতে হবে। রাজনীতি, ব্যবসা ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে দুর্নীতি কমবে না। ব্যবসায়ী মহল, অসাধু আমলা ও রাজনীতিবিদের একাংশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে সড়ক ও মহাসড়কসহ সকল ক্রয়খাতকে জিম্মি করেছিলো। এমন পরিস্থিতি সামনের দিনে যেন অব্যাহত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’

গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে টিআইবির ১৬ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- সকল সরকারি কার্যক্রমে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব আইন’’ প্রণয়ন করা, সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানে এই আইনের প্রতিফলন নিশ্চিত করা; উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি-বিধান ও নির্দেশিকার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা; সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া করায়ত্ত করা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা; অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন, কার্যকর মূল্যায়ন ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নিয়ে প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধি-বিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা সংস্কার করা; প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সকল ধরনের ক্রয় কার্যক্রম ই-জিপি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা; সকল উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সম্ভাব্যতা সমীক্ষার বাধ্যবাধকতার বিধান করা ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন ও রিসার্চ এসোসিয়েট মো. মোস্তফা কামাল। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।

টিআইবি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend