ঢাকা | বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ |
২১ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিন

'নতুন বাংলাদেশ' বিনির্মাণের পথে সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রায় কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ: টিআইবি

'নতুন বাংলাদেশ' বিনির্মাণের পথে সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রায় কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ: টিআইবি
'নতুন বাংলাদেশ' বিনির্মাণের পথে সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রায় কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ: টিআইবি

“নতুন বাংলাদেশ” বিনির্মাণের পথে সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের ১০০ দিনের ওপর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আজ নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। টিআইবি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সময়োচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, যা “নতুন বাংলাদেশ”-এর অভীষ্ট অর্জনের সহায়ক, তবে একইসঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ।

ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্রসংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া অটলভাবে চলমান থাকবে আশা প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদের সৃষ্ট বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকার অসংখ্য সময়োচিত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, পাশাপাশি কয়েকটি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকলেও নতুন বাংলাদেশ বিনিমার্ণের পথে অগ্রগতি দৃশ্যমান। বিশেষ করে, কর্তৃত্ববাদী সরকারকর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও বহুমাত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু, আন্দোলনে আহতদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের উদ্যোগ, যদিও এ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তি ও অসন্তোষ রয়েছে; সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর মতো নিপীড়নমূলক আইন বাতিল, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সাক্ষর, গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশন গঠন, রাষ্ট্র সংস্কারের মূল খাতগুলোকে চিহ্নিত করে সংস্কার কমিশনসমূহ গঠন, আর্থিক খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তনের সূচনা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্দোলনের চিরস্থায়ী স্বীকৃতি ও সম্মানের দৃষ্টান্ত হিসেবে গণভবনকে যাদুঘরে রূপান্তরের পদক্ষেপ, পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ কর্তৃত্ববাদের দোসরদের দুর্নীতির জবাবদিহি প্রক্রিয়া ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কৌশলগত পদক্ষেপ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রত্যাশিত অর্জন সম্ভব হয়নি, একইভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অগ্রগতিতেও ঘাটতি দৃশ্যমান। বিদ্যমান সিন্ডিকেটের শিকড় অনেক গভীরে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও চর্চার পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার অভীষ্ট অর্জনের অবকাঠামো তৈরির বিশাল দায়িত্ব পালনে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়ন না করা, শিক্ষাখাত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতকে সংস্কার উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত না করা, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগ্রহণে অ্যাড-হক প্রবণতা লক্ষণীয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো- বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সংস্কারের উদ্যোগ আমরা দেখিনি। তা ছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব সত্ত্বেও শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিতে প্রত্যাশিত পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ঘাটতি এবং কোনো কোনো গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও হুমকি-হামলাসহ বন্ধ করার তৎপরতা উদ্বেগের কারণ বলে মনে করে টিআইবি।’

রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতে সংস্কার ও নির্বাচনের সময় প্রসঙ্গে ড. জামান বলেন, ‘শুধুমাত্র সরকার পরিবর্তনের জন্য ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়নি, হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনসমূহের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্র সংস্কার না হয় এবং যদি এ লক্ষ্যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি না করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা হয়, তাহলে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মূল চেতনা ও অভীষ্ট বাস্তবায়নে ঝুঁকি থেকে যাবে। সরকারের দায়িত্ব হবে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে অর্পিত দায়িত্ব পালনে কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করা।’

“‘নতুন বাংলাদেশ’: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিনের ওপর পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, একদিকে রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার বহুমাত্রিক ভিত্তি ও অংশীজনের ভূমিকা রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে চলার পথে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১০০ দিনে সংস্কার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের তদন্ত ও বিচার, আর্থিক খাত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অংশ। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাস্তবায়নে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়নের সুযোগ নেওয়া হয়নি, যা এখনো অনুপস্থিত। আবার, আন্দোলনে সংঘটিত সহিংসতার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ও তথ্য-প্রমাণভিত্তিক মামলা দায়ের করার উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া ঢালাওভাবে শত শত মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামী করার ফলে মূল অপরাধীর উপযুক্ত বিচারের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন পুনর্গঠনে চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে।

গবেষণায় আরওদ উঠে এসেছে, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অ্যাড-হক প্রবণতা, উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও দায়িত্ব বণ্টনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়েছে। প্রশাসন পরিচালনায় সরকারের দক্ষতা ও কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীলদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দলীয়করণের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত বিধায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি বাড়ছে বলে শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি এখনো চলমান - একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও দলীয়করণের পরিবর্তে আরেকটি গোষ্ঠীর প্রতিস্থাপন/ হাতবদল হয়েছে বলে লক্ষ করা যায়। কর্তৃত্ববাদ পতনের ক্ষেত্রে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব সত্ত্বেও শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিতে প্রত্যাশিত পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ করা যায়।

গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের পক্ষ থেকে সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার প্রশ্নে ধৈর্যের ঘাটতি লক্ষণীয়। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি, যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কারের মূল চেতনা ধারণ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ বলে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অভূতপূর্ব বিকাশ ও প্রভাব লক্ষ করা যায়। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অসাধারণ। তাদের সীমাহীন ত্যাগ ও সাহস না থাকলে এই অভূতপূর্ব অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। তবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের অগ্রাধিকার রাষ্ট্র্র সংস্কার হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান ও রাজনৈতিক সহনশীলতার ঘাটতি রয়েছে।

গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও হুমকি-হামলাসহ কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার তৎপরতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কোনো কোনো মহলের অতিক্ষমতায়ন ও তার অপব্যবহার এবং চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অসাম্প্রদায়িক সম-অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অভীষ্টের পথে অন্তরায়। সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। তাছাড়া, ভারত কর্তৃক কর্তৃত্ববাদ পতনের বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকারে ব্যর্থতা ও তার কারণে অপতৎপরতার ফলে ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনে সরকার ও দেশের জন্য ঝুঁকি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মনোভাব ইতিবাচক হলেও প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক সহায়তা, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ এর মতো সংস্থার ঋণ সহায়তা-সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি ও বিশেষ করে ইতোমধ্যে সুদসহ ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত দায় সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম গবেষণার পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।

কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন,নতুন বাংলাদেশ,টিআইবি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend