ঢাকা | রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ |
২৪ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

বিশেষজ্ঞ মতামত

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইটি বিপর্যয় ! দায় কার

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইটি বিপর্যয় ! দায় কার
ইকবাল আহমদ ফখরুল হাসান, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ডিভাইন আইটি লিমিটেড । ইকবাল বাংলাদেশে ২০ বছরের অধিক সময় আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন ।

গত কয়েক দিন যাবত আমরা সবাই বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং ও ইএএফটি প্রসেসিং সমস্যার কথা শুনতে পাচ্ছি । ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া ছাড়াও অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম প্রায় । কিন্তু আমরা যেই সব নিউজ দেখতে পাচ্ছি সেই সব নিউজ পরিপূর্ণ না হওয়ার কারণে ব্যাবসায়ীদের ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অনেকখানি সংশয় তৈরি হয়েছে।

বেশিরভাগ নিউজে যেটা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এর মতিঝিল ও মিরপুর ডাটা সেন্টার এর ফাইবার অপটিক্স ক্যাবল কাটা পড়েছে, যার জন্য সার্ভারগুলো সমস্যা করছে । এটা ঠিক করার জন্য মাইক্রোসফট ও ভিএমওয়্যার এর ইঞ্জিনিয়াররা ঠিক করার চেষ্টা করছে। খুবই দুর্বোধ্য একটি নিউজ । ডিজিটাল বাংলাদেশের মানচিত্রে বসে একজন অভিজ্ঞ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের ও এই নিউজ বুঝতে কঠিন হচ্ছে।

একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো কিভাবে একটি সফটওয়ার তৈরি বা কাজ করে , এটার উপর মাইক্রোসফট ও ভিএমওয়্যার বা অন্য ভেন্ডরদের নির্ভরশীলতা কি বা মতিঝিল মিরপুর ডাটা সেন্টারের ব্যবহৃত কী ও ফাইবার কাটা পড়লে পুরো জিনিসটা কিভাবে কাজ না করতে পারে বা এটার জন্য কারা দায়ী হতে পারে বা কি করা যেতে পারে।

কিভাবে সফটওয়ার তৈরি হয়: একটা ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াকে ( বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ক্ষেত্রে চেক ক্লিয়ারিং ও ইএএফটি প্রসেসিং) প্রোগ্রামিং ল্যাঙগুয়েজ এর মাধ্যমে সহজ্যতর ডাটা এন্ট্রি, ডাটা প্রসেসিং ও সর্বোপরি সুরক্ষিত ভাবে ডাটা সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া কে সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট বলা হয়। এই সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট এর আউটপুট একটি প্রোগ্রাম বা সফটওয়ার । যে কোনো সফটওয়ার তৈরির ক্ষেত্রে এটার অপারেটিং প্লাটফর্ম ( বা অপারেটিং সিস্টেম), ডাটাবেজ প্লাটফর্ম ও ইউজার প্লাটফর্ম ও ডাটা স্টোরেজ এর পদ্ধতি কি হবে এগুলো চিন্তা করে আর্কিটেকচার ডিজাইন করা হয় । খুব জরুরি বিষয়ে সফটওয়ার তৈরির ক্ষেত্রে এটার সুরক্ষা, ব্যাকআপ ও সার্বক্ষণিক উপস্থিতি (হাই এভাইলাবিলিটি) এটার আর্কিটেচারাল ডিজাইনে সংযুক্ত করা হয়। যে কোনো প্রতিষ্ঠান সফটওয়ার তৈরির জন্য সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করে সফটওয়ার তৈরি করতে পারেন অথবা চুক্তির মাধ্যমে সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট এ পারদর্শী প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করতে পারেন।

ওপেন সোর্স ও প্রপ্রিয়েটারি সফটওয়ার ও প্লাটফর্ম: যেই সকল সফটওয়ারের কোড বা সোর্স পরিবর্তন বা পরিবর্ধন এর জন্য উম্মুক্ত থাকে সেগুলো কে ওপেন সোর্স আর যেগুলো তে এই সুযোগ গুলা থাকেনা সে গুলোকে ক্লোজ সোর্স বা প্রপ্রাইটরি সফটওয়ার বলা হয় । যেমন "ওপেন অফিস" একটি ওপেন সোর্স ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়ার , অন্য দিকে "মাইক্রোসফট অফিস" একটি ক্লোজ সোর্স সফটওয়ার। প্লাটফর্ম ( অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ, ব্রাউজার) এর ক্ষেত্রে একই রকম ভাবে ওপেন ও ক্লোজ সোর্স বলা হয়। যেমন লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম ওপেন সোর্স আবার মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ক্লোজড সোর্স । ওপেন সোর্স ও ক্লোজ সোর্স এর মধ্যে অনেক ভালো খারাপের বিতর্ক থাকলেও দুটোরই যার যার মতো ভালো ও খারাপ দিক থাকে ।

ডাটাসেন্টার কি এবং কেন: সুরক্ষিত ভাবে ডাটা সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত সুবিধাসম্পন্ন স্থাপনা কে ডাটা সেন্টার বলা হয়।বুঝার সুবিধার্তে, ডাটা সংরক্ষণ এর পাশাপাশি এটি সফটওয়ারের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার স্থাপনা । যদি কোনো কারণে প্রথম লোকেশনে কোনো ভাবে সংযোগ না পেলে অথবা প্রথম লোকেশন কোনো কারণে বন্ধ হলে দ্বিতীয় লোকেশন দিয়ে সফটওয়্যার ব্যবহারকারিরা এটির পূর্ণ ব্যবহার করতে পারবেন । ব্যবহারকারী কখনোই বুঝতে পারবেনা যে একটি লোকেশন বন্ধ বা কোনো সমস্যা রয়েছে । একমাত্র দুটি লোকেশনই সমস্যা করলে বা বন্ধ হলে ব্যবহারকারীর কাজ ব্যহত হবে । এইজন্য দ্বিতীয় ডাটা সেন্টারকে প্রয়োজন মতো ডাটা রিকভারি সেন্টার ও বলা হয় । বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের কাছে দুটি ডাটা সেন্টার এ সমস্যার মতই মনে হচ্ছে।

মতিঝিল ও মিরপুর ফাইবার কানেক্টিভিটি: যেহেতু সফটওয়্যার ব্যাবহারকারি একসঙ্গে একটি লোকেশনে সংযুক্ত থাকে এবং অন্য টি সব ডাটা রিয়েলটাইম কপি করে যাতে কখনো একটি বন্ধ হলে অন্যটি ব্যবহার হয়, সেহেতু মতিঝিল ডাটা সেন্টার থেকে মিরপুর ডাটা সেন্টার ফাইবার সংযোগ কোনোভাবেই ব্যাবহারকারীকে বাধাগ্রস্ত করার কারণ নেই যদিনা দ্বিতীয় লোকেশনের পাওয়ার ইকুইপমেন্ট, সার্ভার হার্ডওয়ার, অপারেটিং সিস্টেম, স্টোরেজ হার্ডওয়ার, ডাটাবেজ, সফটওয়ার বা এরসঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো প্লাটফর্ম ( ভিএমওয়্যার হতে পারে) যদি সমস্যা না হয়। তার মানে ডাটা সেন্টার গুলোর মধ্যকার ফাইবার সংযোগ এখানে মূল সমস্যা নয় যদি না এটা ব্যবহারকারি ব্যাংক এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ফাইবার না হয়। বলে রাখা ভালো, ব্যাবহারকারি ও ডাটা সেন্টার গুলোর সংযোগ ফাইবার বরাবরই আলাদা হয়।

মাইক্রোসফট ও ভিএমওয়্যার এর সম্ভাব্য ব্যবহার: ধারণা করা যায় মাইক্রোসফট এর সার্ভার অপারেটিং সিস্টেম মাইক্রোসফট উইন্ডোজ সার্ভার এবং ভিএমওয়্যার এর ভার্চুয়ালাইজেশন অপারেটিং সিস্টেম বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যবহৃত হয়। এখানে ধারণা করা যেতে পারে কোনো একটি সাইটে এগুলো নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি অথবা ক্ষণিক ত্রুটি তৈরি হয়েছে যার ফলে এটা আর চালানো সম্ভব হইনি। এখানে আমরা বলে রাখতে পারি, সার্ভার প্লাটফর্ম বা অপারেটিং সিস্টেমের কোনো ত্রুটি ঠিক করতে এত লম্বা সময় প্রয়োজন হতনা যদি ত্রুটির মাত্রা বড় না হয়। বাংলাদেশ বা ঢাকার ফাইবার কানেক্টিভিটি তে বর্তমান অবস্থা যতখানি ভালো তাতে কানেক্টিভিটি ঠিক করতে এত সময় প্রয়োজন হওয়ার কথা না। এতে খুব সহজেই বলতে পারা যায় যে মাইক্রোসফট অপারেটিং সিস্টেম বা ভিএমওয়ার বা স্টোরেজ বা মূল সফটওয়ারটিতে বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে।

কে বা কারা দায় এড়াতে পারবেন না:আমি প্রথমে এক কথায় আইটি প্রকিওরমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কে দায়ী করবো । কারণ এই সফটওয়ারটির গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে সার্ভিস লেভেল চুক্তি দেশী ও বিদেশী সকল সম্পৃক্ত হার্ডওয়ার সফটওয়ার ও ডাটা সেন্টার ভেন্ডরদের সঙ্গে যে ধরনের চুক্তি থাকার কথা সেটি নেই। এই সফটওয়ারের গুরুত্ব অনুযায়ী প্রথমেই এটি কোনোভাবে বন্ধ হবেনা এইরকম চুক্তি থাকা উচিত ছিল এবং এটার সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডাটা সেন্টারের ব্যাবহার গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদি সকল ভেন্ডরদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সফটওয়ার উপস্থিতি চুক্তিতে না তাহলে সর্বোচ্চ কতক্ষন বন্ধ থাকতে পারে সেটার ঘোষণা থাকা জরুরি। ফিনান্সিয়াল সফটওয়ারের এই ধরনের চুক্তিতে বন্ধ থাকার সময় ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকার কারণে ডাটা ইন্সুরেন্স থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় দায়ীদের মধ্যে সফটওয়ার আর্কিটেক্টদের বলা সম্ভব, কারণ সফটওয়ারটির ডিজাইনে যদি সার্বক্ষণিক উপস্তিতির জন্য ডিজাইন করা না হলে সেটি একটি বড়ো সমস্যা । সফটওয়ার অভ্যন্তরীণ টীম দিয়ে তৈরি হলে তাদের নিয়োগ ও কাজ মোতাবেক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে ও কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি করলে চুক্তি মোতাবেক দায়ী হবে।

তৃতীয়ত, ভেন্ডররা দায় এড়াতে পারবেন না যদি চুক্তি মোতাবেক কাজ না দেয়া বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারে, হোক সেটা ফাইবার, হোক হার্ডওয়ার বা অপারেটিং সিস্টেম কিংবা সফটওয়ার প্রস্তুতকারী বা রক্ষনাবেক্ষনকারি প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ভেন্ডর কোঅর্ডিনেশন কমিটি ( যদি থাকে) ও এটার দায় নিতে হবে অন্যথায় অনেক গুলা ভেন্ডর একে অপরের উপর দায় চাপিয়ে দীর্ঘসুত্রিতা তৈরি করতে পারেন ।

সর্বোপরি, বাংলাদেশে আইটি প্রকিউর্মেন্ট এর জন্য সিপিটিউ ( সেন্ট্রাল প্রকিউর্মেন্ট ইউনিট টেকনিক্যাল) এর পিপিআর ( পাবলিক প্রকিউর্মেন্ট রুলস) এ ভালো ও শক্ত চুক্তির ব্যবস্থাপনা নেই। যার পরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ আইটি সেবা খুব দূর্বল চুক্তিতে ক্রয় হচ্ছে ও ক্ষতির দায় এড়ানো সহজ হচ্ছে।

ইকবাল আহমদ ফখরুল হাসান, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ডিভাইন আইটি লিমিটেড । ইকবাল বাংলাদেশে ২০ বছরের অধিক সময় আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন ।

বাংলাদেশ ব্যাংক,চেক ক্লিয়ারিং,ইএএফটি,মাইক্রোসফট,ভিএমওয়্যার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend