প্রত্যেক মানুষের জীবনে সাকসেসের পিছনে একটা টার্ননিং পয়েন্ট থাকে, কেউ না কেউ পাশে থাকে, একটা গল্প থাকে।
আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা যৌথ পরিবারে ফেনী জেলার ফুলগাজি উপজেলায়, যাকে বলে একেবারে গ্রামের ছেলে। এসএসসি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া। তারপর উচ্চ শিক্ষার্থে ঢাকায় আগমন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় আমি ব্যাপক ফাঁকিবাজ ছিলাম। তবুও ব্যাপক শৃঙ্খলার মধ্যে কেটেছে আমাদের কিশোর জীবন। সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকার দুঃস্বপ্ন কখনো দেখতাম না। তবে ফাইনাল পরীক্ষার পর কিছু স্বাধীনতা ভোগ করতাম।
আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের গ্রামে কারেন্ট ছিল না, হারিকেন দিয়ে লেখাপড়া করতাম লজিং মাস্টার কাছে। এখনো মনে আছে রাতে বেলা কাচারি ঘরে হারিকেনের চিমনিতে মাথা লাগিয়ে, কপাল গরম করে স্যারকে বলতাম, দেখেন জ্বর এসেছে ছুটি দেন... টিচার কপালে হাত রেখেই ছুটি দিয়ে দিতেন।তবে ছুটি দেয়ার পর মাঝে মধ্যে মা-বাবার হাতে ধরা খেতাম।তবে যৌথ পরিবারে বেঁড়ে ওঠা আমাকে দিয়েছে অনেক কিছু। শেয়ারিং, কেয়ারিং, সহানুভূতি, পরে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে পারা – এই সবই আমার যৌথ পরিবারের শিক্ষা।
প্রচণ্ড সুশৃঙ্খল একটা ছেলে কলেজে পড়ার জন্য হটাৎ ঢাকায় এসে দিশাহীনভাবে ব্যাপক স্বাধীন হয়ে গেলো। গ্রামের স্কুলে এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েও ঢাকার কোন ভাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় টিকলাম না। অবশেষে বিশেষ কৃপায় তিতুমির কলেজে ভর্তি হলাম বিজ্ঞান বিভাগে, বাবার স্বপ্ন ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।
স্বাধীন জীবনে পেয়ে স্কুলের পড়ালিখায় চরম ফাঁকিবাজ ছেলেটি আরও বেপরয়া ফাঁকিবাজ হয়ে গেলো। পড়া লেখা আমার ভালো লাগে না। নাটক, সিনেমা, অভিনয়, গান, গীটার, উপস্থাপনা এগুলো বেশী ভালো লাগে। যা হবার তাই হল, এইচএসসি ফেল করে ফেললাম।
চরম হতাশা নেমে আসলো আমার জীবনে। আমার সকল আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজন সবাই বলতে শুরু করলো “আমি শেষ, আমাকে দিয়ে জীবনে আর কিছুই হবে না”। সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাবার। এমন সময় আমার প্রিয় বাবা আমাকে সাহস দিলেন, বললেন “তোমার উপর আমার আস্থা আছে, আবার শুরু করো”। আমি যেন প্রাণ ফিরে ফেলাম।
যাই হউক কোন রকম সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে ইনটারমিডিয়েট পাশ করলাম। আবারও আমাকে নিয়ে আপমান সুচক কথা “আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, বড় জোর জীবনে মাষ্টারি করতে পারবো বা কোন রকম একটা চাকরী করবো!”। আলহামদুলিল্লাহ্ তাঁদের এই দোয়া কবুল হয়েছে – এখন আমি লাখো শিক্ষার্থীদের পড়াই ও শিখাই।
পরিবারের সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার নাম্বারই পেলাম না। এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি, চট্রগ্রাম ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গিরনগর ইউনিভার্সিটি এমন কি জগন্নাথ কলেজেও ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম না। আবার আমাকে নিয়ে টিটকারি ও হাসির রোল, “আমি শেষ, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না”
ততদিন আমি আমার জীবনটাকে চিনে ফেলেছি, খুঁজে পেয়েছি জীবনের মানে। কাউকে না জানিয়ে ভর্তি হলাম আবার তিতুমির কলেজে বিকম এ। এতদিন পড়ে আসা সাইন্স থেকে ইউটার্ন করে কমার্সে। আবার আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা – “অনার্স পরারও যোগ্যতা হল না!!!” আমার বন্ধু-বান্ধবরাও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
এর পর থেকে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড কাজে লাগাতে থাকলাম। পড়া লেখা, টিউশনি, পার্ট টাইম কাজ সব একসাথে শুরু করলাম। বিকমে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে সোজা চার্টার্ড একাউন্টেন্সি ভর্তি হলাম। ততদিনে সবাই দেখি আমার দিকে ঘুরে তাকাতে শুরু করলো।
আমার বন্ধুরা অনার্স থার্ড ইয়ারে বা ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ারে পড়ছে আর আমি রোজগার শুরু করে দিয়েছি, সিএ পড়ে ও পার্ট টাইম কাজ করে। এবং তখন ভয়ঙ্কর এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়লাম।
বাবাকে বললাম আমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাই। বাবা বললেন তুমি তো এখনো লেখা পড়া করো, এতো তাড়াতাড়ি কেন? আমি বললাম পছন্দ করে রাখো। বাবা বললেন আগে সিএ ইন্টার পাস করে দেখাও তারপর ভাববো। খবর নিলাম সিএ ইন্টার পাশ করতে কত দিন লাগে? বড় ভাইরা জানালেন ৪-৫ বার পরীক্ষা দিলে পাশ করে যাবা। মেয়েটিকে পাবার নেশায় একবারে পাশ করলাম। ৩ বছর প্রেম করেছি, কোন দিন ডেটিং করিনি, কারণ ক্যারিয়ারে সফল হওয়া আমাকে পাগল করে তুলেছিল।
অথচ আমার জীবনে একসময় অনেকেই মনে করতো আমাকে দিয়ে কিছু হবে না! অনেক কষ্ট পেতাম, নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হতো এটা তো আমি নই। তারপর মাস্টার্স ও সিএ পড়লাম, এরপর এমবিএ। ক্যারিয়ার শুরু করলাম হিসাব বিভাগে, ভালো লাগলো না, তারপর মার্কেটিং অবশেষে উদ্যোক্তা।
গ্রামীণ সাইবারনেট আমার জীবনের প্রথম চাকুরী। চাকুরীর ৩ মাস বয়সে আমি বিয়ে করে ফেলি। গ্রামীণ সাইবারনেট এ চাকুরী না করলে ইন্টারনেট তথা তথ্য প্রযুক্তিটা ভালো করে শিখা হতো না বা প্রযুক্তির প্রতি একটা ভালবাসা তৈরি হতো না । গ্রামীণ সাইবারনেট এ আমি ছিলাম আকাউনটস ম্যানেজার হিসাবে।
৯-৫ টা চাকরী আমার ভাল লাগতো না। আমার মনে হতো আমি যা করতে পারি তার খুব সামান্যই আমি প্রয়োগ করতে পারছি চাকরীতে। মাথার মধ্যে একটা স্বপ্ন সব সময়ে তাড়া করতো, নিজের একটা কোম্পানি থাকতে হবে, সেখানে অনেক মানুষ কাজ করবে। ৫ বন্ধু মিলে এরকম একটা স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরুও করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আর চাকরী ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, তা শুধু স্বপ্নই রয়ে গেল।
গ্রামীণ সাইবারনেটে জব না করলে অপটিম্যাক্স কমিউনিকেসান লিমিটেড হতো না । গ্রামীণ সাইবারনেট না ছাড়লেও অপটিম্যাক্স হতো না, তাহলে হয়তো গ্রামীণ সাইবারনেটেই বা অন্য কোথাও জব করা হতো ।
তারপর গেলাম গ্রামীণ শক্তিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে । গ্রামীণ শক্তিতে না গেলে অপটিম্যাক্স হতো না কারণ ওখানে গিয়ে স্বপ্ন সত্যি করার কাজ শুরু করি। তারপর আর থামতে হয় নি।
ক্যারিয়ার শুরু করার ১০ বছর পর ২ টা মাস্টার্স – এম কম ও এমবিএ করেছি।
তারপর শুরু হল অপটিম্যাক্স এর যাত্রা যা আমার ব্রেইন চাইল্ড। কিন্তু যাত্রাটা অতটা শুভ ছিল না। ১৮ মাস এর মাথায় কোম্পানি বন্ধ হবার উপক্রম হল। একই সময়ে অসুস্থ হয়ে আমার হাতের উপর মারা গেলেন আমার প্রিয় বাবা। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার!
লোভনীয় মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানির চাকরী চালিয়ে যাবো? নাকি চাকরী ছেড়ে শুধু ব্যবসায় মনোযোগ দিবো? নিজের সাথে বোঝাপড়া করে অনিশ্চয়তার জীবন হাতে নিয়ে চাকরী ছেড়ে দিলাম। তারপর যারপর নাই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ও অস্বাভাবিক পরিশ্রম করে ও মেধা খাঁটিয়ে আবার হাটি হাটি পা পা করে পরবর্তী ২-৫ বছরে ঘুরে দাঁড়ালাম। যে কোম্পানির বয়স এখন ১৯ বছর।
মাঝখানে কিছুদিন সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড এ জব করেছি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে । উদ্দেশ্য ছিল মাল্টিনেশানাল কোম্পানিতে জব এর স্বাদ নেয়া ও কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করা। এবং কিছু দিন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছি, পড়িয়েছি উদ্যোক্তা বিষয়ে নিয়ে।
এটা ছিল অপটিম্যাক্স এর শুরুর দিকে। তখন আমি সিঙ্গার বাংলাদেশ এ জব ও অপটিম্যাক্সের কাজ দুটাই একসাথে করতাম। প্রতিদিন গড়ে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতাম, এখনো তাই করি। সিঙ্গার বাংলাদেশের জবে আমার অভিজ্ঞতা অপটিম্যাক্সের গ্রোথ এ অনেক বেশী সাহায্য করেছে।
মাঝখানে আরও একটা কোম্পানি তৈরি করেছিলাম, অতিমাত্রায় আয় রোজগারের সম্ভবনা দেখা দেয়ায়, দ্রুত ঐ কোম্পানি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই, কারণ সবসময় সৎ থাকতে বাবা শিখিয়েছেন। বুক ফুলিয়ে চলার আশায় ভালোমানুষ হবার লোভটা সবসময় জাগিয়ে রেখেছি।
বেশ কয়েকবার দেশের বাইরে সেটেল হবার সুযোগ থাকলেও যাইনি। কারণ আমার দেশে থাকতেই বেশী ভালো লাগে কিউট যতসব সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে। একদিন ফুড়ুৎ করে মরে যাবো – মনে রাখার মতো কিছু একটা তো করা দরকার।
জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিলাম চাকরী করবো না, চাকরী সৃষ্টি করবো। জীবনে সফলতা মানে শুধু বাড়ি, গাড়ী ও টাকা নয়, সফলতা মানে সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, সুখ ও সম্পদ আর একজন ভালোমানুষ। আজ আমি আমার সহকর্মীদের ২০০টি পরিবারের হাসি মুখ প্রতিদিন দেখতে পাই – এটাই আমার কাছে সফলতা।‘নিজের বলার মতো একটা গল্প’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট ইকবাল বাহার
এছাড়াও আমার আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে, সবই প্রযুক্তি সম্পৃক্ত উদ্যোগ। প্রযুক্তির মাধমে একটু অন্যরকম সেবা দেয়ার প্রত্যয়। আমার কাছে এখন নতুন কিছু করা মানে নিজের সাথে আরও কিছু মানুষকে স্বপ্ন দেখানো এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা।
নিজে স্বপ্ন দেখি ও তরুণদের স্বপ্ন দেখাই – এটা আমার দেশের জন্য কাজ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা যা আমি কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়া করি এবং প্রতিদিন প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা সময় দিই “নিজের বলার মতো একটা গল্প” ফাউন্ডেশনে। গত প্রায় ৬ বছরে প্রায় ৬৮৪,০০০ জনেরও বেশী তরুণের মাঝে “প্রতিদিন প্রশিক্ষণ” দিয়ে এই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে পেরেছি – এটাই আমার বিশাল প্রাপ্তি। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১০০,০০০ জন উদ্যোক্তা/ব্যবসায়ী হয়ে এখন অন্যদেরকে চাকরী দিচ্ছে, দেশে প্রায় ৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হতে ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার এবং দেশে বেকারত্ব কিছুটা হলেও কমানোর এই স্বপ্ন এখন আরও অনেক বড় হয়েছে। আগামী ২ বছরে আরো ৩ লাখ উদ্যোক্তা/ব্যবসায়ী তৈরি করবো – তাঁরা একদিন ১০ লাখ মানুষের কর্ম সংস্থান তৈরি করবে এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করবো ১০,০০,০০০ ভালোমানুষ ও পজিটিভ মানুষের।
আর টিভি নিউজ প্রেজেনটেশান ও বিজনেস প্রোগ্রাম উপস্থাপনা, ওটাতো শখ করে করা।
এসএসসি পাশ করেই চামেলি আমার জীবনে চলে আসে, আমাদের বিবাহ হয়। তারপর তার এইসএসসি, গ্রাজুয়েশান, মাস্টার্স, ফ্যাশান ডিজাইনিং, আবার এমবিএ করে আমার পাশে পাশে থেকেই। এখন সে একটা কোম্পানির সিইও আর এটিএন বাংলা টিভি নিউজ প্রেজেন্টার। আমার বউ – চামেলি আমার জীবনে না এলে এবং ওর সহযোগিতা না পেলে আমার জীবনে অনেক কিছুই হতো না।
১৮ বছর আগে অপটিম্যাক্সের শুরুর দিকে মারাত্মক ক্রাইসিসের সময় আমার প্রাণ প্রিয় বাবা মারা গেলেন । আমার চারিদিকে যেন শুধু অন্ধকার । তারপর থেকে আমার মা আমার কাছে, উনার সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি । এই ২জন মানুষের দোয়া আমার জীবনের সব সফলতার চাবিকাঠি ।
জীবনের প্রায় সকল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী পেলেও ক্যারিয়ার, পরিবার, আত্মীয় পরিজন ও বন্ধু বান্ধব ও নিজের কাছে প্রথম শ্রেণীতে থাকাটা কখনো হাত ছাড়া করিনি।
সর্বোপরি আমার কাছে সফলতা মানে খুশি থাকা।
এখন আপনাদের লাখো তরুণদের “নিজের বলার মত একটা গল্প” তৈরির জন্য লেগে থাকবো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইনশাল্লাহ... এই কাজ আমার বিবেক ও আত্মাকে শান্তি, আমাকে আনন্দ দেয়।