সৌদি আরব থেকে মিয়ানমার, ইরাক থেকে ইথিওপিয়া। বিভিন্ন দেশের বাহিনী সংগ্রহ করছে চীনের মনুষ্যবিহীন সামরিক ড্রোন। এসব ড্রোন সংঘাতে, যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সামরিক ড্রোনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠেছে চীন। এই সুবাদে চীন হয়ে উঠেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সামরিক ড্রোন রপ্তানিকারক দেশ।
ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের সামরিক অভিযানে চীনা ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। আট বছর ধরে আকাশপথে এ জোটের চালানো হামলায় ইয়েমেনের ৮ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষের প্রাণ গেছে।
ইরাক সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা চীনা ড্রোন ব্যবহার করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ওপর ২৬০টির বেশি হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় সফলতার হার প্রায় শত ভাগ।
চীনা সামরিক ড্রোন ব্যবহারে পিছিয়ে নেই মিয়ানমারও। গত দুই বছরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশটির গণতন্ত্রপন্থী সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সশস্ত্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে আকাশপথে শত শত হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় তারা চীনা ড্রোন ব্যবহার করেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী।
অন্যদিকে, আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের দমনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলির অন্যতম অস্ত্র ছিল চীনা ড্রোন। পাশাপাশি ইরান ও তুরস্কে তৈরি ড্রোনও ব্যবহার করেছেন তিনি।
চীনে তৈরি সামরিক ড্রোনের অন্য ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে মরক্কো, মিসর, আলজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, সার্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশ। এই ড্রোন আকাশ থেকে ভূমিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম। আবার তারা গোয়েন্দা তথ্যও সংগ্রহ করতে পারে।
সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে চীন বিশ্বের ১৭টি দেশকে অন্তত ২৮২টি সামরিক ড্রোন সরবরাহ করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় সামরিক ড্রোন রপ্তানিকারক দেশ হয়ে ওঠে।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ১২টি সামরিক ড্রোন বিদেশে রপ্তানি করেছে। ওয়াশিংটন এসব সামরিক ড্রোন ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে দিয়েছে। তবে গোয়েন্দা নজরদারির কাজে ব্যবহৃত নিরস্ত্র ড্রোন রপ্তানিতে এখনো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত এক দশকে সশস্ত্র ড্রোনের বাজারে চীনা আধিপত্যের পেছনে এই খাতে দেশটির সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দেশটির সামরিক বাহিনীকে বিশ্বমানের করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর মতে, সশস্ত্র ড্রোন যেকোনো যুদ্ধের পরিস্থিতিকে অনেক বেশি পরিবর্তন করতে সক্ষম।
গত বছর চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেস হয়। এই কংগ্রেসে সি চিন পিং সশস্ত্র-নিরস্ত্রসহ সব ধরনের ড্রোনের বিকাশ ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো জন স্কাউস বলেন, চীনের তথ্যভিত্তিক যুদ্ধ ধারণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ড্রোন। এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তি সীমান্ত থেকে দূরের কোনো এলাকায় শারীরিকভাবে উপস্থিত না থেকেও অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এতে অবকাঠামোগত বা রাজনৈতিক ঝুঁকিও কম।
যদিও এখন পর্যন্ত চীন কোথাও ড্রোন হামলা চালিয়েছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফর ঘিরে তাইওয়ানের চারপাশ ঘিরে সামরিক মহড়া চালায় বেইজিং। এই মহড়ায় যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি সামরিক ড্রোন ব্যবহার করা হয়।
তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে চীন। দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি নাকচ করেনি বেইজিং। তাই বলা যায়, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে যেকোনো সংঘাতে চীনা সামরিক ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
চীনা সামরিক বিশ্লেষক ফু কিয়ানশাও গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির মালিকানাধীন ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, তাইওয়ান প্রণালিতে যেকোনো সংঘাত-সংঘর্ষের ক্ষেত্রে প্রথমেই মোতায়েন করা অস্ত্রগুলোর একটি হবে সামরিক ড্রোন।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরাও সতর্ক করে বলছেন, তাইওয়ানকে ঘিরে যেকোনো সংঘর্ষ-সংঘাতের শুরুতেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ড্রোন ব্যবহার করতে পারে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)।
এখন পর্যন্ত চীনের ড্রোন প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো, অন্যান্য দেশের সক্ষমতার প্রতিলিপি করা। এমনটাই মনে করেন প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সংবাদমাধ্যম জেনসের প্রতিবেদক অখিল কাদিদাল। তিনি উল্লেখ করেন, চীন সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে ‘চাইহং-৪’ নামের ড্রোন। এটা অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমকিউ-৯ র্যাপার ড্রোনের মতো। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের এমকিউ-১ প্রিডেটরের আদলে উইং লুং-২ নামের ড্রোন বানিয়েছে চীন। মূলত পশ্চিমা প্রতিপক্ষদের পেছনে ফেলতে চীন এসব ড্রোন বানিয়েছে। দেশটি এই খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে।
উইং লুং-২ ও উইং লুং-৩ ড্রোনের উদাহরণ টেনে অখিল বলেন, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সমগোত্রীয় ড্রোনের তুলনায় দ্রুতগতিসম্পন্ন। এমনকি চীনের এসব ড্রোন অধিকতর অস্ত্র বহনে সক্ষম। নকশা ও সক্ষমতা বিবেচনায় এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোনের প্রায় কাছাকাছি। তবে চীনের তৈরি এই ড্রোনের দাম তুলনামূলক কম। তাই ক্রেতারা চীনা ড্রোনের দিকে বেশি ঝুঁকছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান সিএসআইএসের তথ্য অনুযায়ী, চীনের তৈরি সিএইচ-৪ ও উইং লুং-২ কিনতে একেকটির জন্য ক্রেতাকে গুনতে হয় ১০ থেকে ২০ লাখ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একেকটি এমকিউ-৯ র্যাপার ড্রোনের দাম প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এমকিউ-১ প্রিডেটরের দাম কিছুটা কম, ৪০ লাখ ডলার। তাই তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে চীনা ড্রোনের চাহিদা বেশি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো ডগলাস ব্যারি বলেন, চীনের তৈরি ড্রোনের দাম তুলনামূলক কম। কিছু ক্ষেত্রে সক্ষমতা কিছুটা কম। তবে ক্রেতাদের কাছে সক্ষমতার তুলনায় দামটা হয়তো বেশি প্রাধান্য পায়। তাই চীনা ড্রোনের চাহিদা বাড়ছে।
ক্রেতাদের ড্রোনের দাম পরিশোধের ক্ষেত্রে চীন নমনীয় শর্ত দিচ্ছে। এ বিষয়ে বেইজিংভিত্তিক বিশ্লেষক ঝোউ চেনমিং গত বছর চীনা সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছিলেন, চীনা কোম্পানিগুলো ভালোভাবে জানে যে তাদের ড্রোনের অন্যতম ক্রেতা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো খুব বেশি ধনী নয়। এসব দেশ নগদ অর্থে ড্রোন কিনতে সক্ষম নয়। সে ক্ষেত্রে ক্রেতাদের কিস্তির সুবিধা দিচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো। এমনকি ক্রেতা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়েও ড্রোন দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ড্রোনের বাজারে চীনা আধিপত্যের অন্যতম বড় একটি কারণ হলো, এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ। তাই ক্রেতা দেশগুলো চীনের দিকে বেশি ঝুঁকছে।
১৯৮৭ সালের মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিমের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ড্রোন রপ্তানি সীমিত রেখেছে। এই কারণে জর্ডান, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ড্রোন কেনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ওয়াশিংটন। পরে এসব দেশ চীনের দ্বারস্থ হয়।
আইআইএসএসের জ্যেষ্ঠ ফেলো ফ্রাঞ্জ-স্টিফেন গ্যাডির মতে, ড্রোন বিক্রিতে চীনের নিয়ন্ত্রণ বা বিধিনিষেধ কম, তাই তাদের ক্রেতাও বেশি।