দুবাইয়ে অবস্থান করে জেট রোবটিক নামে অ্যাপের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল হুন্ডি’ চালিয়ে আসছিলেন কুমিল্লার শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠানোর দায়িত্ব নিতেন। আর এ দেশে মামুনের প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বজনের কাছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পৌঁছে দিতেন। এভাবে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে চক্রটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেছে বা দেশে আসতে দেয়নি।
চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন– একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ডিস্ট্রিবিউটর তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসের মালিক নাসিম আহেমেদ, এজেন্ট সিমের টেরিটরি সেলস ম্যানেজার ফজলে রাব্বি সুমন ও মো. কামরুজ্জামান এবং জেট রোবটিক অ্যাপের এ দেশীয় প্রতিনিধি জহির উদ্দিন ও খায়রুল ইসলাম পিয়াস। বুধবার রাতে চট্টগ্রামে এ অভিযান চালায় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ছয়টি মোবাইল ফোন, ১৮টি সিমকার্ড, একটি ল্যাপটপ, ছয়টি মডেম ও ২৮ লাখ ৫১ হাজার ২০০ টাকা।
রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডিপ্রধান বলেন, চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে অবস্থিত তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসের রয়েছে ওই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ১০০টি এজেন্ট সিম। সেগুলোর মধ্যে যেসব সিমের লেনদেন সন্তোষজনক নয়, সেসব জেট রোবটিক অ্যাপ ব্যবহারকারীদের কাছে সরবরাহ করা হতো। এজেন্ট সিমে ওই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান থেকে ই-মানি আনা হয়। সেই সিমের কয়েকটি ভাড়া নেয় জেট রোবটিক অ্যাপ। হুন্ডি চক্রটির মূল হোতা মামুন দুবাইয়ে বসে অ্যাপের মাধ্যমে এজেন্ট সিমের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যান।
সিআইডিপ্রধান বলেন, মামুন ২০২০ সাল থেকে দুবাইয়ে রয়েছেন। সেখানে তিনিসহ পাঁচজন অ্যাপটি নিয়ন্ত্রণ করেন। মালয়েশিয়ান সফটওয়্যার ডেভেলপারের মাধ্যমে তৈরি করা এই অ্যাপ কাস্টমাইজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন তারা। ফলে ওই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট সিমগুলো বাংলাদেশে থাকলেও তারা দুবাই বসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে, তারা এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করেন। সেই অর্থ দেশে কার কাছে, কোন নম্বর বা ব্যাংক হিসাবে পাঠাতে হবে জেনে নেন। পরে বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা এজেন্ট সিম ব্যবহার করে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চক্রটি তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসের ১৫০টি এজেন্ট সিম ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে সিআইডির অনুসন্ধানে ৪৮টি সিমে অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেছে।
এ ঘটনায় তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটস দায় এড়াতে পারে কিনা জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, তারা অবশ্যই দায় এড়াতে পারে না। ওই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট সিম পেয়ে থাকেন কেবল যাচাই করা এজেন্টরাই। তারা তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসেরও যাচাইকৃত। তারা যদি এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে দায় তাদের ওপরও বর্তায়। আমরা তাসমিয়ার মালিককে গ্রেপ্তার করেছি। অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ভয়াবহ। যেসব এজেন্ট তাদের লেনদেনের টার্গেট পূরণ করতে পারেন না, তাদের বাদ দেওয়া হয়। সেই এজেন্ট সিম জেট রোবটিক অ্যাপকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভাড়া দেওয়া হয়। তাসমিয়ার এসও (সেলস অফিসার) এবং ডিএসও (ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার) এর ভাগ পেতেন। এ কারণে খুব গোপনভাবেই বিষয়টি চলছিল। ধরা পড়ার পর এখন এটার কার্যক্রম বন্ধের জন্য বিটিআরসিকেও জানানো হয়েছে। শুধু এই অ্যাপই নয়, এমন বেশ কিছু অ্যাপ বাংলাদেশে চলমান। ইতোমধ্যে আমরা কিছু অ্যাপের সন্ধান পেয়েছি। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় এই কার্যক্রম চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, আমরা আরও পাঁচ-সাতটি প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যারা দুবাই থেকে একই ধরনের অ্যাপের মাধ্যমে হুন্ডি চালাচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রম রোধে সিআইডিসহ সব দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। এটার দায়িত্ব ডিবি, র্যা ব এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও। তিনি বলেন, ওই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সিম ব্যবহার করে বেআইনি কার্যক্রম হলে তা দেখার দায়িত্বও তাদের। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির টেরিটরি অফিসার ও ফিল্ড অফিসার সবাই মামলার আসামি হবেন।