বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে মন্তব্য বা কটুক্তি করা যাবে না। কোনো ধর্মের অনুসারীদের আহত করে বা আঘাত দেয়-এমন মন্তব্য বা বিষয় প্রচার করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কিছু করা যাবে না।
ঋণ খেলাপী ও ঋণের দায়ে দেউলিয়া হওয়া ব্যক্তিরা বাংলাদেশে কোনো ওয়েবসাইট বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছ থেকে নিবন্ধন পাবে না।
সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইনে বিনোদনমূলক প্ল্যাটফর্মগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি বিটিআরসি-র রেগুলেশনের খসড়ায় এই শর্ত দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিটি ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে বিনোদনমূলক প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য বিটিআরসির কাছ থেকে নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে খসড়া রেগুলেশনে।
এই নিবন্ধন পেতে হলে বিটিআরসি আরও কিছু শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পরিচলিত যেকোনো ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অফিস বাংলাদেশে থাকতে হবে।
সেইসাথে বাংলাদেশে তাদের ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স এবং ভ্যাট সার্টিফিকেট থাকতে হবে। এছাড়াও, অনলাইন নিউজ বা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, অনলাইন কিউরেটেড কন্টেন্ট বা ওয়েব-ভিত্তিক প্রোগ্রাম, ফিল্ম এবং সিরিজের প্রকাশকদের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তির শংসাপত্র নেওয়া উচিত।
কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধের দায়ে দুই বছর দণ্ডিত হলে এবং কারামুক্তির পর ৫ বছর অতিবাহিত না হলে তিনি কোনো নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি ঋণের দায়ে দেউলিয়া ঘোষিত হলে এবং ব্যাংক কর্তৃক খেলাপী ঘোষিত হলেও তিনিও নিবন্ধন পাওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
'দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস' নামের খসড়া নীতিমালাটি গত ৩ ফেব্রুয়ারি জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই নীতিমালার ওপর মতামত দেওয়া যাবে বিটিআরসির ই-মেইলে।
সম্প্রতি, হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী এই নীতিমালা প্রনয়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসির কর্তৃপক্ষ।
তবে এই খসড়া নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে যা নিয়ে সমালোচনা করেছে আইনজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা।
বিটিআরসির কমিশনার (আইন) জেষ্ঠ্য জেলা জজ আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন বলেন, "সামাজিক মাধ্যমসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য অনেক নিয়মের কথা প্রস্তাব করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের জন্য রাখা হয়েছে অনেক নিয়ম। সামাজিক মাধ্যম বর্তমানে বল্গাহীন ভাবে চলছে। সেখানে কোন শৃঙ্খলা নাই। শৃঙ্খলা এবং নিয়মতান্ত্রিক তার মধ্যে আনার জন্য আমাদের এই কার্যক্রম।"
তিনি বলেন, নীতিলার খসড়া অনুযায়ী, ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য এবং খবর প্রচার বা পোস্ট করলে তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে মন্তব্য বা কটুক্তি করা যাবে না। কোনো ধর্মের অনুসারীদের আহত করে বা আঘাত দেয়-এমন মন্তব্য বা বিষয় প্রচার করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কিছু করা যাবে না।
কেউ এসব পোস্ট বা প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নেটফ্লিক্স, হইচই এবং অ্যামাজন প্রাইমসহ বিনোদনের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে অশ্লীল এবং অনৈতিক কোনো কন্টেন্ট প্রচার করা যাবে না, এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে নতুন নীতিমালার খসড়ায়।
তবে নীতিমলায় এরকম কঠোরতা নিয়ে বিরোধীতা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, "এখন বাংলাদেশে কোনো ইস্যু নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ করলে তাতে বাধা আসে। এমনকি অন্য কোন মাধ্যমে প্রতিবাদ করা যায় না। সেখানে ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম মত প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটাকেও এখন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।"
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে এবং তাতেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কী করা যাবে বা করা যাবে না-এসব বলা আছে। এ অবস্থায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আরও খর্ব করার জন্য সুনিদিষ্ট নীতিমালা করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
কোনো ব্যক্তিকে হেয় করা বা অন্য দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়, এমন কিছু করা যাবে না বলা হয়েছে খসড়ায়। এগুলো কিভাবে নির্ণয় করা হবে-এই প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদের অনেকে।
বিটিআরসির সংশিষ্টরা জানিয়েছেন, ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন সময় দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু ধর্মের দুর্গা পূজার সময় কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা এবং ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
বিটিআরসি বলছে, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনাগুলোর পর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যমে শৃঙ্খলার বিষয়ে একজন আইনজীবী রিট মামলা করেছিলেন।
সেই রিট মামলার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট বিটিআরসিকে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশে তারা নীতিমালার খসড়া তৈরি করে তা ইতোমধ্যে আদালতে পেশ করেছেন।
নীতিমালা প্রণয়ন হলে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় নিশ্চিত হবে বলেও জানান তারা।