গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবা পৌঁছে দিতে ২০১২ সালে ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ প্রকল্প নেয় সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ মানুষকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা, ইন্টারনেট সুবিধাসহ অন্যান্য ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করা। তবে এক দশক পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এমনকি সারা দেশে একটি বড় অংশে এখনো ‘পোস্ট ই-সেন্টার’-এর কার্যক্রম শুরুই করা সম্ভব হয়নি। প্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবাটির বিষয়ে সাধারণ মানুষ এখনো ঠিকঠাক জানে না। প্রকল্পটি নেয়ার ক্ষেত্রে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন না করা এবং বাস্তবায়নের পর যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে এটি লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্পটি নেয় সরকার। এর আওতায় জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে ৮ হাজার ৫০০ পোস্ট অফিসকে পোস্ট ই-সেন্টারে রূপান্তর করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া, রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে সহায়তা, ডাকঘরকে ডিজিটালাইজড, কৃষি স্বাস্থ্য ও সেবা বিষয়ে তথ্য সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কমার্শিয়াল পোস্টাল সার্ভিসের সূচনা, আইটিভিত্তিক পল্লী উদ্যোক্তা তৈরি, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার এবং পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সার্ভিসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তবে এত বছর পার হয়ে গেলেও প্রকল্পটির উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে অনেক পোস্ট ই-সেন্টারের অবকাঠামো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। অপ্রতুল যেমন আসবাবপত্র, তেমনি প্রয়োজনীয় ডিজিটাল সরঞ্জামেও রয়েছে সংকট। যে কারণে কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা প্রচার-প্রচারণার অভাব। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো কিছুই জানেন না।
পোস্ট ই-সেন্টারের বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুরের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সামিউল ইসলাম জানান ডিজিটাল এ সেবাটির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, ‘ই-মেইলে তথ্য আদান-প্রদানসহ নানা প্রয়োজনে ই-মেইল সেবা নিতে আমরা দোকানে যাই। কোনো দিন পোস্ট ই-সেন্টারের নামই তো শুনিনি। এ নামে কোনো সেন্টার যদি থেকে থাকে, তাহলে এগুলো জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার-প্রচারণা দরকার ছিল।’ কেবল মো. সামিউল নন, অনেকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, তাদের সবাই পোস্ট ই-সেন্টার নামটি প্রথম শুনছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯৬টি পোস্ট অফিসে পোস্ট ই-সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হলেও এখন প্রায় ২০০ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি এ জেলার অধিকাংশ ই-সেন্টারও বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। কম্পিউটার বিকলের পাশাপাশি নিজস্ব পোস্ট অফিস না থাকায় জেলার ত্রিশাল উপজেলার গফাকড়ি পোস্ট অফিসে এ সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ত্রিশালের বাগান পোস্ট অফিসেও একই দশা। তবে মুক্তাগাছা উপজেলা পোস্ট অফিসে কিছু কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা আব্দুল মান্নান।
বিষয়টি স্বীকার করে ময়মনসিংহ জেলা পোস্ট অফিস পরিদর্শক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ জেলার পোস্ট ই-সেন্টারের সবগুলো বন্ধ হয়নি। কিছু এখনো চালু আছে।’
তবে পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। এটি বাস্তবায়নকালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম হিসেবে ল্যাপটপের সঙ্গে বিল্ট ইন ক্যামেরা সংযুক্ত থাকলেও কেনা হয় অতিরিক্ত ৮ হাজার ৫০০ ওয়েব ক্যামেরা। সেন্টারগুলোর জন্যও কেনা হয় বাড়তি ৮ হাজার ৫০০ প্রিন্টার। প্রয়োজন না থাকলেও ৫০০টি অতিরিক্ত হার্ড ডিস্ক কেনা হয়। এসব যন্ত্রপাতি কিনতে খরচ হয় ৭ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) এক অডিট প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদন বলা হয়, পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব পণ্য কেনা হয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
সারা দেশে ৯০০ পোস্ট ই-সেন্টারে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সিএজি। অডিটকালে দেখা যায় এসব সেন্টারের ২০ শতাংশ যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেন্টারগুলোর ৭০ শতাংশ আসবাবপত্রের কোনো অস্তিত্বই পায়নি সিএজি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোস্টাল সেভিংস ব্যাংক ও পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কার্যক্রম প্রসারিত করা, পল্লী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় করা, ভাতা বিতরণ, তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি, পল্লী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রেমিট্যান্স সেবা প্রসার, শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়ায় ব্যর্থ হয়েছে সেন্টারগুলো। সেন্টার স্থাপনের পর প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জন যাচাই করতে মনিটরিংও করেনি ডাক বিভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাবনার একজন পোস্ট মাস্টার বলেন, ‘তার আওতাধীন ই-সেন্টারগুলোর মধ্যে কিছু সেন্টার চলছে, আবার কিছু সেন্টারের যন্ত্রাংশ কাজ করে না। আবার অনেক অফিসে ই-সেন্টারই করা হয়নি। যেসব যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যায় সেগুলো মেরামতেরও সুযোগ থাকে না।’
উপজেলা পর্যায়ের অন্তত ১০ জন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, উপজেলার প্রত্যেকটি ডাকঘরে পোস্ট ই-সেন্টার করে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন কার্যক্রম চললেও পরে যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এসব ই-সেন্টার। এখন আর সেগুলো চলছে না। ই-সেন্টারগুলোর একটি যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে বাকিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।
তারা জানান, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বার বার চিঠি দিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে প্রচারণার অভাবে খুব বেশি মানুষ ই-সেন্টার সম্পর্কে জানেও না।
চট্টগ্রামের পোস্ট ই-সেন্টারের একাধিক উদ্যোক্তা জানান, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এখনো শতভাগ মানুষের কাছে পোস্ট ই-সেন্টারের তথ্য পৌঁছেনি। সেজন্য সরকারের এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়নি। ইকুইপমেন্টসের স্বল্পতা, স্থায়ী অফিস না থাকায় মানুষের কাছে সেবা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে বলেও জানান এসব উদ্যোক্তারা।
প্রকল্প নেয়ার বিষয়ে সমালোচনা করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে নেয়া হয়েছে। যার জন্য এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। প্রকল্পটি যখন নেয়া হয় তখন ডাক বিভাগের জনবল, তাদের সক্ষমতা, কর্মদক্ষতার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যে কারণে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর লোকবলের অভাবে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়, অনেক সেন্টার চালু করা যায়নি। এখন প্রকল্পের আনুষঙ্গিক বিষয় মূল্যায়ন করে দেখব কীভাবে এর সঠিক বাস্তবায়ন করা যায়।’