ঢাকা | শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ |
২২ °সে
|
বাংলা কনভার্টার
walton

আইসিটি'র ডেটা সেন্টারও দুর্নীতিতে এগিয়ে

আইসিটি'র ডেটা সেন্টারও দুর্নীতিতে এগিয়ে
প্রতিমন্ত্রী পলক

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডে (বিডিসিসিএল) জনবল নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আবেদনের শর্ত শিথিল, পরীক্ষাকেন্দ্র পরিবর্তন, প্রভাবশালীদের সুপারিশসহ অনিয়মের মাধ্যমে সংস্থাটি একের পর এক জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই অনিয়মের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের। অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুর্নীতি করেছেন ইচ্ছামতো। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে দেড় হাজার কোটি টাকায় স্থাপিত প্রকল্পটি অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় তৈরি করা হয় ফোর টায়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার। এটি নির্মাণে কাজ করে চীনের কোম্পানি জেডটিই। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর শুরু হয়ে নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতায় ব্যয় বাড়ে আরও ১০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এটি পরিচালনায় বিডিসিসিএল গঠন করা হয়।

যত অনিয়ম-দুর্নীতি

২০২১ সালে প্রথমবারের মতো বিডিসিসিএলে জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী পলকের পছন্দের লোক নিতে নিয়োগ বিধি সংশোধন করে ২০২২ সালে আবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ সময় বিভিন্ন পদে যোগ্যতা শিথিল করা হয়। কয়েকটি পদের পরীক্ষা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি) এবং বাকি পদের পরীক্ষা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) হয়। নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন বিসিসির নির্বাহী পরিচালক রঞ্জিত কুমার, সদস্য সচিব ছিলেন বিডিসিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু সাইদ চৌধুরী। তারা দু’জনই নিজেদের এবং পলকের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে অনিয়মের আশ্রয় নেন।

বিসিসি ও বুয়েটে একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা হয়। কিন্তু বিসিসিতে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যবস্থাপক ও সহকারী ব্যবস্থাপকসহ ১০ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যাচাই না করেই ২০২২ সালের ডিসেম্বরের সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব আবু সাইদ চৌধুরী এবং বিডিসিসিএল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও আইসিটি বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব জিয়াউল আলম দু-এক মাসের মধ্যে এলপিআরে (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) যাবেন বলে পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে তাড়াহুড়ো করা হয়। অন্যদিকে বুয়েটে অনুষ্ঠিত কারিগরি পদে নির্বাচিতদের ওই সময়ে নিয়োগ হয়নি। তাদের তথ্য পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআইর মাধ্যমে যাচাইয়ের জন্য ফাইল পাঠানো হয়। এক বছরের বেশি সময় চলে যাচাই কার্যক্রম। নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২৪ সালের শুরুতে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বুয়েটে মেধার ভিত্তিতে নির্বাচিত অনেক প্রার্থী আগেই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।

বিডিসিসিএল পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন এক সদস্য এবং সাবেক এমডি আবু সাইদের সুপারিশে নিয়োগ পান ব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) ফিরোজ শরীফ। ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) মুরাদ আলম মনিরকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মুখ্য সচিবের সরাসরি সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া হয়। পলকের সাবেক একান্ত সচিব সাইফুল ইসলামের চাচাতো ভাই সহকারী ব্যবস্থাপক (লজিস্টিক) মইনুল হোসেন। তাঁর মাধ্যমে বিডিসিসিএলে নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি। সহকারী ব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) তৌকির আইসিটি বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব জিয়াউল আলমের বড় জামাই। জিয়াউল তখন বিডিসিসিএলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর বড় মেয়ে প্রথমে এটুআইয়ে কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে স্টার্টআপ বাংলাদেশ কোম্পানিতে বাবার সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত। জিয়াউল এলপিআরে যাওয়ার আগেই মেয়ে ও জামাইয়ের নিয়োগ নিশ্চিত করেন। সহকারী ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) দোলা সাহার বাড়ি পলকের এলাকা নাটোরের সিংড়ায় এবং তিনি পলকের শিক্ষকের মেয়ে।

ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) ইকরামুল হক নিয়োগ পাওয়ার পর নিজ বড় ভাই এনামুল হক ও তাঁর সহযোগী আজগরের মাধ্যমে নিয়ম ভেঙে অফিস স্টেশনারিসহ বিভিন্ন মালপত্র সরবরাহ করেন। এতে সহযোগিতা করেন ব্যবস্থাপক ফিরোজ শরীফ। একই সঙ্গে ইকরাম যশোরে নিজ এলাকায় একটি ক্লিনিকের দায়িত্বে রয়েছেন, যা বিডিসিসিএলের চাকরিবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বেচ্ছাসেবক লীগের আইটি সম্পাদক শাকিল আহম্মেদ জুয়েলের (বাবু) কোম্পানি রেনিডেন্সকে দিয়ে ডেটা সেন্টারের বিভিন্ন স্পেয়ার পার্টস কেনাকাটায় কমিশন নিতেন। ব্যবস্থাপক (ব্রান্ডিং ও মার্কেটিং) রঞ্জিত কুমার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিংয়ের কাজ করে কমিশন নেন বলে অভিযোগ আছে। ব্যবস্থাপক মুরাদ আলম মনির বিডিসিসিএলের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে পছন্দের লোকদের কাজ দিতেন।

২০২৩ সালে আরেক দফা জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় বিডিসিসিএল। পলকের চাপে এবার কারিগরি পদের পরীক্ষা বুয়েটের পরিবর্তে বিসিসিতে হয়, যাতে পছন্দের প্রার্থীদের সহজেই নিয়োগ দেওয়া যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন কম্পিউটার অপারেটর দ্বীন ইসলাম। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জ। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ফারুক খানের সুপারিশ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশে নিয়োগ পান তিনি। কম্পিউটার অপারেটর সাজ্জাদুর রহমানের বাবা শেখ হাসিনার পেন্ট্রিম্যান ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনের সুপারিশে তাঁর চাকরি হয়। উপসহকারী প্রকৌশলী (ট্রান্সমিশন) মুশফিক প্রতিমন্ত্রী পলকের একান্ত সচিব মুশফিকুর রহমানের আত্মীয়।

বুয়েটে ফেল বিসিসিতে প্রথম

২০২৩ সালে বিসিসিতে যে নিয়োগ পরীক্ষা (লিখিত) হয়, তাতে ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক ও ট্রান্সমিশন) পদে নিয়োগ পাওয়া কামরুজ্জামান প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ২০২২ সালে বুয়েটে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রভাবশালী সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সহসভাপতি ছিলেন। সংগঠনটির সভাপতি আমিনুল বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক মামুন নিয়োগের জন্য পলকের কাছে তদবির করেন। বিডিসিসিএল যখন প্রকল্প ছিল (ফোর টায়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন প্রকল্প), তখন তাতে ছিলেন কামরুজ্জামান। শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখরের সুপারিশে কামরুজ্জামানকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহ। লিখিত পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বেশি দিয়ে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে অনিয়ম, নারী কেলেংকারিসহ ছয়টি সুস্পষ্ট অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। দোষী প্রমাণ হওয়ায় ২০১৯ সালের মার্চে চাকরিচ্যুত হন কামরুজ্জামান। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ও মোজাম্মেল হক তাঁকে আবার চাকরি দিতে পলকের কাছে সুপারিশ করেন। পরে তাঁকে অনিয়মের মাধ্যমে বিডিসিসিএলে নেওয়া হয়।

ডেটা সেন্টার প্রকল্পে থাকার সময়ে কামরুজ্জামান সামিট টেলিকম, মাইক্রোসফটের সোনিয়া বশির, আমরা নেটওয়ার্ক, ফ্লোরা লিমিটেডসহ অনেক ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। ডেটা সেন্টার প্রকল্পে থাকার সময় ইনফো সরকারের প্রকল্প পরিচালক বিকর্ন কুমার ঘোষের সঙ্গে কিছুদিন অতিরিক্ত দায়িত্বে সংযুক্ত ছিলেন তিনি। এখানেও বিভিন্ন ভেন্ডরের কাছ থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ হলে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও বিতর্কিত ভূমিকা ছিল কামরুজ্জামানের। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সক্রিয় সদস্য হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত ২২ আগস্ট বিসিসি ও বিডিসিসিএলের সাত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয় আইসিটি বিভাগ। আদেশের ৬ নম্বরে ছিলেন কামরুজ্জামান। পরবর্তী সময়ে তাঁকে বাদ দিয়ে ছয়জনের বিষয়ে ফের আদেশ জারি করে আইসিটি বিভাগ।

একটি সূত্র বলছে, আইসিটি বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে (যারা বিডিসিসিএলের দায়িত্বে ছিলেন) ধরে তালিকা থেকে নিজের নাম সরিয়েছেন কামরুজ্জামান। কারণ যে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের মাধ্যমে বিডিসিসিএলে কামরুজ্জামানের চাকরি হয়েছে, সেই নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন ওই দুই কর্মকর্তা। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে কামরুজ্জামানকে তালিকা থেকে বাদ দিতে ভূমিকা রেখেছেন।

জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনিয়ম চিহ্নিত করতে একটি কমিটি কাজ করছে। তারা শিগগিরই প্রতিবেদন দেবে। সে আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে অনেক অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডে (বিডিসিসিএল),জনবল নিয়োগে অনিয়ম,দুর্নীতি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Transcend