মোবাইল কল ও ইন্টরনেটের দাম গ্রাহক পর্যায়ে সাশ্রয়ী করতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের ছেঁটে ফেলতে যাচ্ছে অন্তরবর্তীকালীন সরকার। সেই লক্ষ্য নিয়ে ৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেয়েছে টেলিকমিউনিকেশন্স নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং পলিসি ২০২৫। এতে অতীতের লাইসেন্সিং কাঠামো ভেঙ্গে চার স্তর বিশিষ্ট লাইসেন্সিং ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এতে সেবা মান ও কাভারের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও মোবাইল ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমভিএনও), ভিও-ওয়াইফাই, ওয়াইফাই ৬, ওয়াইফাই ৭, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), এআই ইত্যাদি আধুনিকতম প্রযুক্তিগত সেবার সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। একই সাথে নিত্যনতুন ডিজিটাল সার্ভিস প্রদানের প্রতিবন্ধকতা দূর করে নতুনদের বিশেষত এসএমইদের জন্য উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
নীতিমালাটি সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের কার্যকারিতা আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ বিষয়ক সহকারী উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। একইসঙ্গে ভয়েস কল ও ডেটায় প্রতিযোগিতা তৈরি করে ইন্টারনেট গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতার অধীনে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নতুন নীতিমালায় বিদেশী মালিকানা কমিয়ে আনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে শতভাগ বিদেশি মালিকানা ৮৫ শতাংশে নামি আনা হয়েছে। এজন্য আগামী তিন বছরের মধ্যে মোবাইল অপারেটরদের অন্তত ১৫ শতাংশ মালিকানা শেয়ার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। তবে বিষয়টি দেশের শেয়ার বাজারের সক্ষমতার উপর নির্ভর করবে।
নতুন লাইসেন্স নীতিমালার নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের জবাবে ফয়েজ বলেন, আইএলডিএস পলিসি অবলোপন এখানে শৃঙ্খলা আনা হয়েছে। আমরা কারো লাইসেন্স কেড়ে দেব না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ লাইসেন্সের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবেন।
'লাইসেন্সের প্রথম স্তর শেষে এখন দ্বিতীয় স্তর চলছে' জানিয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়ব বললেন এখন মাইগ্রেশন পর্যায়ে চলছে। লাইসেন্স হবে তিন স্তরের। যারা লাইসেন্সের উপরের স্তরে আসতে চান তাদেরকে নতুন করে বিটিআরসিতে আবেদন করে নতুন স্তরের লাইসেন্স নিতে হবে।
টেলিকম খাতের একচেটিয়া ব্যবসায় ভেঙে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে নতুন নীতিমালা বিষয়ে বিশেষ সহকারি জানালেন, এখন লাইসেন্স তিনটি স্থরে সমীবদ্ধ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সদস্য চালু হওয়া স্যাটেলাইট টেলিযোগাযোগের জন্য আরেকটি লাইসেন্স এর অপশন রাখা হয়েছে। বাদ বাকি লাইসেন্সকে ডিরেগুলেট করে এনলিস্টের অধীনে আনা হয়েছে।
নতুন লাইসেন্স নীতিমালা ব্যবসায় বান্ধব উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগের নীতিমালা আগামীতে কেউ একাধিক স্তরে এক লাইসেন্সের অধীনে ব্যবসা করতে পারবে না।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ফয়েজ আহমদ তৈয়ব বললেন, আমরা যত বেশি ডি রেগুলেশন করব, এসবের জন্য ব্যবসা ততটা সহজ হবে। এসএমই বান্ধব পলিসি করতে আমরা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের আইএসপি ব্যবসায়ীদের লাইট রেগুলেশন এর অধীনে এনেছি। তাদেরকে ন্যাশনাল আইএসপিদের শর্ত মানতে হবে না। অর্থাৎ নতুন পলিসি আগের থেকে অনেক বেশি এসএমই বান্ধব। আমরা বিষয়টি আরো সহজ করতে চেয়েছিলাম। আপত্তির কারণে আমরা এটা পুরোপুরি ডি রেগুলেট করতে পারিনি।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুমোদিত নীতিমালার বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এসব জানান প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সরকারি ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আব্দুন নাসের খান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী এবং বিটিআরসি ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবু বকর ছিদ্দিক এসময় উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, ইতিপূর্বের লাইসেন্স রেজিমে ২৬ ধরনের মোট ৩,২৯৯টি লাইসেন্স থাকার কারণে টেলিকম সেবার মানোন্নয়ন ও গুণগত মান অনুযায়ী দামের সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন নীতিমালায় লাইসেন্স কাঠামোকে মাত্র ৩ প্রকারে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে নাগরিকের চাহিদা অনুযায়ী উন্নত Quality of Service (QoS) নিশ্চিত করতে অধিকতর ফোকাস প্রদান করা সম্ভব হবে।
আগের বহুমাত্রিক লাইসেন্স পদ্ধতির কারণে টেলিকম মার্কেট থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা উল্লেখযোগ্য ভ্যালু এড না করেই রাজস্বের অংশে ভাগ বসাত, যা এই পলিসি দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং তা জলবায়ু অভিঘাতপ্রবণ এলাকায় কাভারেজ সম্প্রসারণ, সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা প্রদানসহ নাগরিকবান্ধব কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা যাবে।
আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক গঠিত কমিটি যার চেয়ারম্যান ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা সেই কমিটির সুপারিশে কেবিনেট ডিভিশনে এই নীতিমালারচ্ছ সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপনের পূর্বে প্রায় ১০টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও কানেক্টিভিটির আওতায় আসবে এবং কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে টেলিকম সেবা কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে। নতুন নীতিমালায় অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ শেয়ারিং এর মাধ্যমে টেলিকম কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে উন্নততর সেবা প্রদান করতে পারবে। এর ফলে টেলিকম সেবার গুণগত মানোন্নয়ন নিশ্চিত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।
এর আগে, গত ২০ জুলাই টেলিকমিউনিকেশনস নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং নীতি, ২০২৫-এর খসড়া পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।